ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪
Sharenews24

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের হাজার কোটি টাকা নিঃশেষ করেছে ১২ প্রতিষ্ঠান

২০২৩ আগস্ট ১১ ১১:০৮:১৩
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের হাজার কোটি টাকা নিঃশেষ করেছে ১২ প্রতিষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। নজিরবিহীন ঋণ কেলেঙ্কারি আর গ্রাহকের আমানতের টাকা লোপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পথ হারিয়ে এখন রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ছাড়া আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম শহীদ রেজা ও প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও আগেই গ্রাহকের জমানো প্রায় সব টাকা চুষে নিঃশেষ করা হয়েছে। পর্ষদ এখন টাকা ফেরত চাইলে খেলাপিরা উল্টো হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার কেউ কেউ ঋণের প্রায় পুরো টাকাই মেরে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে এই বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক। আমরা তা আদায়ের চেষ্টা করছি। ঋণখেলাপিরা বলেন, আমরা তাদের খেলাপি বাড়িয়ে দেখাচ্ছি। বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ নেই। কারণ, আদালতে অসত্য তথ্য দিলে তার দায় তো আমাদের ওপর বর্তাবে। আশা করি, সামনে আমাদের বকেয়া ঋণ আদায় বাড়বে।’

সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, ঋণ কেলেঙ্কারিতে বর্তমানে প্রায় পুরো ব্যাংক ও আর্থিক খাতই প্রশ্নবিদ্ধ। পরিচালকেরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের ব্যাংক থেকে লোপাট করছেন টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের আমানতের টাকা নামে-বেনামে লুটে নেওয়ায় এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া হয়েছে। এই রকমই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে আইএলএফএসএল।

জানা গেছে, আইএলএফএসএলের দেওয়া মোট ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিই ৯১ শতাংশ বা ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানই হাতিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর আগে পি কে হালদার একাই প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেয়। তাদের কার্যক্রমে ত্রুটি থাকলে, তা দেখভালের জন্য পর্যবেক্ষক দেওয়া হয়। এরপরও কেউ অপরাধ করলে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

আইএলএফএসএলএস সূত্রে জানা যায়, আইএলএফএসএল থেকে ১১৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল এ কে এম শহীদ রেজার মালিকানাধীন পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি টাকায়। শহীদ রেজা ঋণ পুনঃ তফসিল করেও বকেয়া অর্থ পরিশোধে গড়িমশি করায় কর্তৃপক্ষ আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছে।

এদিকে, আজম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন ইস্ট কোস্ট গ্রুপের আওতাধীন প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পিএফআই সিকিউরিটিজ ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। একবার পুনঃ তফসিল করা সত্ত্বেও পিএফআই সিকিউরিটিজ ঋণের টাকা পরিশোধে গড়িমসি করে। বর্তমানে মোট পাওনা ১০৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ে অর্থঋণ আদালত-২-এ ১টি, ঢাকার সিএমএম কোর্টে চেক ডিজঅনারের ১৯টি এবং চেক প্রতারণার ১টি মামলা করা হয়। তাতেও টাকা ফেরত পাওয়ায় কোনো অগ্রগতি নেই।

বর্ণালী ফেব্রিকস লিমিটেড ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি টাকায়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদ এখন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক।

বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ঋণ নিয়েছিল ২৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি টাকায়। পাওনা আদায়ে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-২-এ একটি মামলা করা হয়। বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি এম এ বারী ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদের বেয়াই।

মদিনা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। বকেয়ার স্থিতি ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ে মামলা হয়েছে চারটি।

চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট রহমান শিপ ব্রেকার্স লি. এবং এমএম শিপ ব্রেকার্স লি. দুটি হিসাবে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। খেলাপি হওয়ায় পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। মূল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হেফাজুতুর রহমান ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও চেক ডিজঅনারের মামলা চলছে।

রহমান কেমিক্যালস ঋণ নিয়েছিল ৫০ কোটি টাকা; এখন পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। সিমটেক্স টেক্সটাইলস ঋণ নিয়েছিল ৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ২৮ লাখ টাকায়। এমার এন্টারপ্রাইজ ঋণ নেয় ২৮ কোটি টাকা; এখন বকেয়া ৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা; এখন দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ১৭ লাখ টাকায়। কমপ্লিট এডুকেশন আর অলটারনেটিভ ফাউন্ডেশন ১১ কোটি টাকার ঋণ নেয়; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি টাকায়। সামান্নাজ সুপার অয়েল লিমিটেড ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা; সুদসহ বকেয়া ৭০ কোটি টাকা। এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়; এখন তা দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট পাওনা ৯৩৪ কোটি টাকার বেশি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন বলেন, যারা অর্থ পাচার ও লুট করে, তাদের সাজার আওতায় আনতে সময় লাগে। আবার আইনের ফাঁক গলে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। এজন্য একই অপরাধ বারবার ঘটতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে।

শেয়ারনিউজ, ১১ আগস্ট ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে