নিজস্ব প্রতিবেদক: ওটিসি থেকে শেয়ারবাজারের মূল প্লাটফর্মে ফেরা দুই কোম্পানি পেপার প্রসেসিং এবং বিডি মনোস্পুল পেপারের পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ার রাতারাতি তিনগুণ হয়েছে। কী কারণে ও কখন কোম্পানির মূলধন ও শেয়ার বেড়ে গেলো সে বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিগুলোর মূলধন বৃদ্ধির বিষয়টি দুইদিন আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েভ সাইটে প্রকাশ করা হয়। আর এতে করে কোম্পানি দুটির শেয়ারে বড় পতন শুরু হয়েছে। গত দুইদিনে উভয় কোম্পানির শেয়ারে দরপতন হয়েছে ১৯ শতাংশেরও বেশি হারে। উভয় দিনই কোম্পানি দুটির শেয়ার লেনদেনের প্রথম ভাগে ক্রেতাশুন্য হয়ে যায়।
মূল মার্কেটে ফেরার পর কোম্পানিগুলোর শেয়ার সংখ্যা কম ছিল। ফলে কোম্পানি দুটির শেয়ারেরও চাহিদা ছিল ব্যপক। এতে করে ওটিসি থেকে আসার পর শেয়ারগুলোর দাম বাড়ে কয়েকগুণ। অনেক বেশি দামে কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেছে অনেক বিনিয়োগকারী। আর রাতারাতি কোম্পানিগুলোর শেয়ার সংখ্যা তিন গুণ বাড়াতে গত দুই দিনে এই শেয়ারগুলোর ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি ক্ষতির মূখে পড়ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, হঠাৎ মূলধন বা শেয়ার বৃদ্ধির খবরই শেয়ার দুটির দরপতনের মূল কারণ। এর আগে গত ১৩ জুন যখন শেয়ারবাজারে পুনঃতালিকাভুক্ত হয়েছিল কোম্পানি দুটি, তখন খুবই কম মূলধন এবং কম ফ্রি-ফ্লোট শেয়ার থাকার কারণে শেয়ার দরেও ছিল অস্বাভাবিক উল্লম্ফন। প্রায় প্রতিদিনই সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দরে বিক্রেতাশুন্য থেকেছে।
ওটিসি থেকে মাত্র ১৬ টাকা শেয়ারদর নিয়ে ফেরা পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ারদর মাত্র দুই মাসে ২৪৭ টাকায় উঠে। একইভাবে বিডি মনোস্পুল পেপারের শেয়ারদর ৫০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকায় উঠে। যদি পুনঃতালিকাভুক্তির সময় বলা হতো, কোম্পানি দুটির আরও দ্বিগুণের বেশি শেয়ার যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে, তবে এ সময়ে উভয় শেয়ারের বাজারদরে এতটা বাড়ত কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ার সর্বোচ্চ ২৩২ টাকা থেকে সোমবার ১৮৭ টাকা ৭০ পয়সায় নেমেছে। একইভাবে বিডি মনোস্পুল পেপারের ২৩৭ টাকা ৬০ পয়সা থেকে নেমেছে ১৯১ টাকা ২০ পয়সায়। উভয় শেয়ার সোমবার সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে ক্রেতাশুন্য থেকেছে।
শেয়ার দুটি ক্রেতা শূন্য থাকার কারণ খুঁজতে গেলে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাগজ ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কোম্পানির মোট শেয়ার দেখাচ্ছিল ৩৩ লাখ ৬০ হাজার। কিন্তু গত রোববার থেকে দেখাচ্ছে ১ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০টি। এর ফলে আগে যেখানে ফ্রি-ফ্লোট শেয়ার ছিল ১৮ লাখ ৮৩ হাজার, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৮ লাখ ৫৬ হাজারে। একইভাবে বিডি মনোস্পুল পেপারের মোট শেয়ার ৩০ লাখ ৪৮ হাজার থেকে ৯৩ লাখ ৮৯ হাজার হয়েছে। এর ফলে ফ্রি-ফ্লোট শেয়ার ১৪ লাখ ০৭ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখ ৩৫ হাজারে।
হঠাৎ পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ার বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে একই ব্যবসায়িক গ্রুপভুক্ত উভয় কোম্পানির কোম্পানি সচিব মুস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ সালে উভয় কোম্পানির ২০০ শতাংশ হারে বোনাস ডিভিডেন্ড এজিএমে পাশ হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে কোনো ডিভিডেন্ড না দিলেও ২০২০ সালের জন্য পেপার প্রসেসিংয়ের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১১ শতাংশ এবং বিডি মনোস্পুল পেপারের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৮ শতাংশ বোনাস শেয়ার এজিএমে পাস হয়েছিল।
কোম্পানি সচিব আরও জানান, মূল শেয়ারবাজারে থাকা কোম্পানির বোনাস শেয়ার এজিএমে পাস হলে তা শেয়ারহোল্ডারদের বিও অ্যাকাউন্টে জমা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অনুমোদন লাগে না। কিন্তু ওটিসির কোম্পানির এজন্য অনুমোদন নিতে হয়। ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উভয় কোম্পানির এজিএমে ওই বছরের জন্য ২০০ শতাংশ করে পাস হয়েছিল। ওই বোনাস ডিভিডেন্ডের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করলেও তৎকালীন বিএসইসি তা অনুমোদন করেনি। এরপর ২০১৯ সালের জন্য দুই কোম্পানির কোনোটিই ডিভিডেন্ড দেয়নি। তবে ২০২০ সালের জন্য পেপার প্রসেসিং কোম্পানির জন্য ১১ শতাংশ নগদের পাশাপাশি ১১ শতাংশ বোনাস এবং বিডি মনোস্পুল পেপারের জন্য ৯ শতাংশ নগদের পাশাপাশি ৮ শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড পাস হয়েছিল।
মুস্তাফিজুর রহমান জানান, চলতি বছর উভয় বোনাস ডিভিডেন্ডের অনুমোদন দিলে ২০২০ সালের বোনাস ডিভিডেন্ড গত ২০ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ২০০ শতাংশ বোনাস গত ৭ মার্চ শেয়ারহোল্ডারদের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছে। এ তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জকে গত এপ্রিলে এবং পুনঃতালিকাভুক্তির সময়ও দেওয়া হয়েছে। এমনকি তালিকাভুক্তির সময় সমুদয় শেয়ারের হিসাবে লিস্টিং ফি নিয়েছে। কিন্তু মোট শেয়ারের প্রকৃত তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি। এ দায় কোনোভাবে কোম্পানির নয় বলে দাবি তার।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সাইফুর রহমান পাটোয়ারী জানান, কোম্পানি দুটি সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন এবং অন্যান্য নথিতে যে পরিশোধিত মূলধন দেখাচ্ছিল, সে তথ্যই ডিএসই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকলে তার দায় কোম্পানির বলে দাবি তার। তবে এক্ষেত্রে ডিএসই আরও একটু সতর্ক হলে ভুল এড়াতে যেতো বলেও জানান তিনি।
গত জুনে পুনঃতালিকাভুক্তির সময় ও তার দুই মাস আগে গত এপ্রিলে প্রকৃত মূলধন বিষয়ে তথ্য দেওয়ার পরও ডিএসই এ ভুলের দায় কী করে এড়াতে পারে এবং সর্বশেষ গত রোববার ভুলটি সংশোধনের সময়ও ডিএসই কোনো মূলধন বা শেয়ার বৃদ্ধির বিষয়ে পৃথক কোনো নোট বা ব্যাখ্যা দিল না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নোট দিলে ভালো হতো। কোম্পানি ঠিকভাবে তথ্য না দেওয়াতেই সমস্যা হয়েছে বলে ফের দাবি তার।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি, এমনকি এ বিষয়ে না জেনে কোনো মন্তব্য করতেও রাজি হননি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ডিএসই প্রায়শ এ রকম ভুল করছেন। যা তাদের ইচ্ছাকৃত। একটু সতর্ক হলে এ রকম ভুল হওয়ার কথা নয়। তারা বলছেন, কোম্পানি ও ডিএসইর এ ভুলের বড় মাশুল দিতে হবে বিনিয়োগকারীদের। তারা বিষয়টির সুষ্ঠূ তদন্ত দাবি করেছেন এবং দায়ি ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।