নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন এক গবেষণায় দেশের বাজারে জনপ্রিয় ৫টি ব্রান্ড ও ২টি নন-ব্রান্ডের চিনিতে আশঙ্কাজনক মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
গবেষকরা বলছেন, এর পরিমাণ এতই বেশি যে, দেশের সমস্ত জনসংখ্যার দেহে শুধু চিনির মাধ্যমেই গড়ে প্রতিবছর ১০.২ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রবেশ করতে পারে।
গবেষণা দলটির প্রধান ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গবেষণাপত্রটি প্রকাশনার জন্য জনপ্রিয় সায়েন্স জার্নাল 'সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট' কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, এবং খুব শিগগিরই এটি প্রকাশিত হবে।
গবেষক ড. মোস্তাফিজুর বলেছেন, ‘সম্প্রতি এক গবেষণায় মানবদেহের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এবার আমরা আমাদের চিনিতেও এর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছি। পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার, রাসায়নিক প্রকৃতি ও আকৃতিও শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘মানবদেহে এই উপাদানগুলির উপস্থিতি বড় উদ্বেগের বিষয়,’ তিনি উল্লেখ করেন।
গবেষণা বলছে, ‘মানবদেহ কিংবা মানবদেহে প্রবেশের বিভিন্ন মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি একদিকে যেমন উদ্বেগের, একইসাথে দূঃখজনক হলো এটি আমাদের দেহে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে সারা বিশ্বেই কিন্তু গবেষণা এখনও খুবই অপ্রতুল। তবে আমরা পাখি ও ব্যাঙ্গাচিসহ বিভিন্ন প্রাণী উপর গবেষণা করেছি, এবং করছি। তাতে আমরা এসব প্রাণীর দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব লক্ষ করেছি। এটি কিন্তু অন্যান্য দূষনকারী পদার্থকে সাপোর্ট করে, একইসাথে সেকেন্ডারি ভেক্টর হিসাবেও কাজ করে। সুতরাং এটি মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।’
গবেষণাটি প্রায় ৬ মাসব্যাপী চালানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন সুপার মার্কেট থেকে সংগ্রহ করা ৫টি জনপ্রিয় ব্রান্ড ও দুটি নন ব্রান্ডের চিনিতে কেজিপ্রতি গড়ে ৩৪৩.৭টি প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। অধিকাংশ কণাই ৩০০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট আকারের এবং কালো, গোলাপী, নীল, এবং বাদামী বর্ণের।
এছাড়াও এসব প্লাস্টিক কণার মধ্যে রয়েছে এবিএস, পিভিসি, পিইটি, ইভিএ, সিএ, পিটিএফই, এইচডিপিই, পিসি ও নাইলন নামক রাসায়নিক কণা।
গবেষণায় নমুনা হিসেবে পরীক্ষিত ব্র্যান্ডগুলোর নাম প্রকাশ করেননি গবেষকরা। চিনিতে কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে সেবিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, প্রক্রিয়াকরণ বা মোড়কজাত করার সময় প্লাস্টিক কণা চিনিতে প্রবেশ করে থাকতে পারে। আমদানিকৃত চিনিতেও এটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি চিনিতে এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রোধে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে বিএসটিআইসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। চিনিতে যেন পলিমারের কোনো উপকরণ প্রবেশ করতে না পারে সেবিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’
গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালি, শিল্প কলকারখানাসহ প্রতিটি খাতে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নজিরবীহিন পর্যায়ে পৌছেছে। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে এই প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৬৭ মিলিয়ন টন, যার অর্ধেকেই উৎপাদন হয়েছে এশিয়া মহাদেশে। যে কারণে বর্তমানে বিশ্বের কাছে এই অঞ্চল পরিচিতি পেয়েছে প্লাস্টিক দুষণের হটস্পট হিসাবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এরমধ্যেই প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, চাষকৃত চিংড়ি, লবণ, আটা, ফলমূল, শাকসবজি, বিয়ার, মধু, দুধ ও নানান রকম নাস্তার মতো খাদ্যে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী যেভাবে প্রতিনিয়ত পলিমারের ব্যবহার বাড়ছে তাতে এখন আর বিষয়টিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দিনে দিনে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও যেহেতু এখনো মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের প্রভাব সম্পর্কে তেমন বিষদ কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই, তাই এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। একইসাথে পরিবেশে প্লাস্টিকের এই দূষণ কমাতে এখন থেকেই সকলকে সচেতন হয়ে প্লাস্টিকের বিকল্প চিন্তা করতে হবে।’