নিজস্ব প্রতিবেদক : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এই বিষয়ে সম্প্রতি পরিপত্রও জারি করা হয়েছে। এরপরও বিদেশ সফর নিয়ে তোড়জোড় চালাচ্ছেন অনেক সরকারি কর্মকর্তা।
জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার পরও এক্সপোজার, স্টাডি, ইনোভেশন, ওয়ার্কশপ, সেমিনারের জন্য বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করার এসব ট্যুর বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। এই সুযোগে যেসব জিও জারি হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন, সেসব কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণের জন্য সংশ্নিষ্ট দপ্তরে ভিড় করছেন।
কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি করে ট্যুরের টাকাও উত্তোলন করেছেন। এখন নানাভাবে তদবির করে দ্রুত বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা সফর বন্ধের পরও বিদেশে চলে গেছেন।
গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখা সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারি করে।
ওই দিনও বিদ্যুৎ বিভাগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, বেসামরিক বিমান পরিবহন, পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ প্রায় ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একাধিক জিও জারি করা হয়। এর মধ্যে আটটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কয়েকটি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৭টি প্রতিনিধি দলে ৯৮ কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যাওয়ার তালিকায় রয়েছেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ একটি প্রতিনিধি দলের ইতালি ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সফরের রেজিস্ট্রেশনের শেষ দিন ছিল গত রোববার। তাঁদের বাইরে আরও একটি দল যাবে বেলজিয়াম। তাঁদের প্রাথমিক বাছাই হয়েছে বৃহস্পতিবার।
এদিকে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১২ কর্মকর্তা এক্সপোজার ট্যুরে স্পেন ও মরক্কো যাবেন আগামী জুন মাসে। বিদেশ সফর বন্ধের খবর জেনে কর্মকর্তারা ট্যুরের টাকা উত্তোলন করেছেন পরিপত্র জারির আগের দিন। একইভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি (এনএপিডি) ২২ জনের একটি দলের ভ্রমণের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের ৪৩ জন প্রতিনিধির একটি বহর ১৬ দিনের সফরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাচ্ছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। সফরে তাঁর মেয়ে, জামাতা ও চাচাতো ভাই সঙ্গী হচ্ছেন। শুধু প্রতিমন্ত্রী নন, মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জেনেভায় যাচ্ছেন। বহরে আরও থাকছেন দু'জন সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, কয়েকজন শ্রমিক নেতা ও কয়েকটি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা। সম্মেলনটি ২৭ মে শুরু হয়ে চলবে আগামী ১৩ জুন পর্যন্ত।
প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি সরকারের তিনজন কর্মকর্তা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড যাবেন বলে কথা রয়েছে। তাঁদের একজন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরী। তিনি যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী নিঘাত সুলতানাকে নিয়ে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রুবিনা খান, মেয়ে তানিশা কবীরের যাওয়ার কথা। একই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমুল হুদা তাঁর স্ত্রী তাহমিনা হক, ছেলে তাহমিদ শামিমকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষসহ (বেবিচক) বিভিন্ন দপ্তরের প্রকল্পের ট্যুরও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তোড়জোড় চলছে। এসব ট্যুরেও কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানসহ বিদেশ সফরের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারির পরও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর সফরে গেছেন। সিঙ্গাপুরের একটি সামিটে ১৭ মে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি ১৫ মে চলে গেছেন। একইভাবে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান গতকাল সোমবার ছয় দিনের সামিটে স্পেন গেছেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, আইসিটি বিভাগের একটি প্রজেক্ট-সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিদেশ ভ্রমণের জিও জারি করা আছে। এর মধ্যে সরকার বিদেশ ভ্রমণ বন্ধে জিও জারি করেছে। এখনও বিদেশ ভ্রমণের আদেশ স্থগিত করা হয়নি। পর্যালোচনা করে দেখব, সরকারি আদেশ মেনে যাওয়া যাবে কিনা। সুযোগ না থাকলে যেতে পারব না।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদেশ ভ্রমণের জিওতে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, প্রজ্ঞাপনটি অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কখন থেকে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। ফলে এখনও বিদেশ ভ্রমণের আদেশটি স্থগিত করা হয়নি।
বিদেশ যাওয়ার তালিকায় যাঁরা :সুরক্ষা সেবা বিভাগের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এক্সপোজার ভিজিটের জন্য ২০ মে মালয়েশিয়ায় যেতে চান সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব জিয়াউল হক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) কাজী আবেদ হোসেন, অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্লাহ কাজল, ফজলুর রহমান, জাহিদ হোসাইন মোল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালেহ মোহাম্মদ ফিরোজ, উপপরিচালক হামিদুর রশিদ, সহকারী কেমিক্যাল পরীক্ষক আবু হাসান ও সহকারী পরিচালক রামেশ্বর দাস। চলতি সপ্তাহে আইসিটি বিভাগের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ও মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন পরিদর্শনে যাবেন বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এ এন এম সফিকুল ইসলামসহ প্রকল্পের পরিচালক, ইনোভেশন স্পেশালিস্ট ও আইসিটি বিভাগের দু'জন উপসচিব এবং একজন উপপরিচালক। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্টাডি ট্যুরে স্পেন ও তুর্কি যাবে পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম প্রধানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। আগামী ২৫ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের স্টাডি ট্যুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শফি উদ্দিন আহমেদ, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব দিল আফরোজাসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলসহ আরও ২২ কর্মকর্তা পৃথকভাবে যাবেন। ১১ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্টাডি ট্যুরে আমেরিকা যেতে চায় পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম প্রধান মুহাম্মদ আনোয়ার উদ্দীনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি ট্যুরে চারজন যুগ্ম সচিবসহ ১২ কর্মকর্তা স্পেন ও মরক্কো যাবেন। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ছয় দিনের জন্য স্পেন ও নেদারল্যান্ডস যাবেন। তাঁর বিদেশ সফরের অফিস আদেশ গত ১২ মে জারি করা হয়েছে। একইভাবে ঢাকা ওয়াসার একাধিক বিদেশ সফর দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আদেশ জারি করা হয়েছে।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, বিদেশ সফরের পরিপত্রটি অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। অর্থ বিভাগের কাছে শিগগির এই বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। তাদের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
'সরকারি কর্মচারী আইন' বইয়ের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, যেসব ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে তাঁদের বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারির দিন থেকে কার্যকর হবে। এ নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় তাহলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদেশ যাবেন, অন্যথায় কেউ যেতে পারবেন না। এটা পরিস্কারভাবে প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, কোনো প্রয়োজন না থাকলে বিদেশ সফর আর নয়।