নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ মতে, বিগত ছয় (২০১৫-২০২০) বছর বন্যায় দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ এক লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনটির বেশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।
উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারি বৃষ্টির কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা বন্যানিমজ্জিত। বলা হচ্ছে এটি দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা।
নদনদী ও হাওরের পানি বেড়ে বন্যার বিস্তৃতি ঘটায় বেশি। আচমকা পানি বেড়ে ডুবে যায় সব। পানিবন্দি হয়ে পড়েন শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। পাশাপাশি জামালপুর, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলেও দেখা দেয় বন্যা। সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় ৮৪ জনের।
বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ১১টি প্রধান দুর্যোগের বিপরীতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে খানা ধরে ধরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটক যেমন, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, কার্বন নিঃসরণ, গ্রিন হাউজ গ্যাস প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক তথ্য-উপাত্তও বিবিএস’র প্রতিবেদনে উঠে আসে।
বিবিএস জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালে (ছয় বছরে) বন্যায় আর্থিক ক্ষতি নিরূপিত হয়েছিল চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আগের ছয় বছরের তুলনায় পরের ছয় বছরে বন্যায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৪ গুণেরও বেশি।
বন্যায় ৬ বছরে ক্ষতি লাখ কোটি টাকা
বিবিএস জানায়, উল্লিখিত ছয় বছরে (২০১৫-২০২০) প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষিখাত, শস্য, প্রাণিসম্পদ, পোল্ট্রি, মৎস্য, বনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র। সব মিলিয়ে এই খাতে সর্বমোট ক্ষতি ৭১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। যা মোট ক্ষতির ৪০ দশমিক ০৬ শতাংশ। বন্যার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ও অনেক ক্ষতি করেছে উল্লিখিত সময়কালে। এই সময়ে ২৫ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে ঘূর্ণিঝড়।
জমির ক্ষয়-ক্ষতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় জমিজমা। ওই ছয় বছরে খানাভিত্তিক ৮ লাখ ৬৮ হাজার ২০৬ একর জমির মধ্যে বন্যায় সর্বোচ্চ ৪৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত, নদী-উপকূলীয় ভাঙনে ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ, জলমগ্নতায় ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ, অবশিষ্ট জমি অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বেকারত্ব জরিপের প্রতিবেদনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির কিছু চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্যোগের কারণে আক্রান্ত এলাকায় বেকারত্বের অভিশাপ দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। উল্লিখিত ছয় বছরে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খানার সদস্যরা গড়ে ২১ দশমিক ০৩ দিন কর্ম থেকে বিরত ছিলেন। প্রধানত বন্যায় ৪২ দশমিক ৬৮ দিন, নদী/উপকূলীয় ভাঙনে ৩ দশমিক ৮৭ দিন, জলমগ্নতায় ৬ দিন, খরায় ১ দশমিক ৬৩ দিন, জলোচ্ছ্বাসে ১ দশমিক ৫৫ দিন, ঘূর্ণিঝড়ে ২১ দশমিক ২৩ দিন, বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে (কালবৈশাখী ও আশ্বিনী ঝড়সহ) ৬ দশমিক ৫৫ দিন কর্ম থেকে বিরত ছিলেন খানার সদস্যরা।
১৫ শতাংশ খানা তিন দফায় দুর্যোগে আক্রান্ত ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল সময়কালে অর্থাৎ ছয় বছরে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খানাগুলোর মধ্যে ৫৪ শতাংশ খানা একবার, ৩১ শতাংশ খানা দুবার, ১৫ শতাংশ খানা তিন বা ততধিকবার দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে।
দুর্যোগে অসুস্থতা ও আহত ২০১৫-২০২০ সময়কালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ৯২৫ জন খানার সদস্য অসুস্থ এবং এক লাখ ৭২ হাজার ৪২৬ জন আহত হয়েছেন বলে বিডিআরএস ২০২১ জরিপে উঠে এসেছে। আগের ছয় বছরে (২০০৯-২০১৪) দুর্যোগে আহত বা অসুস্থ হয়েছিলেন ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৪ জন খানা সদস্য।
দুর্যোগে শিশুর ক্ষতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ০০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৪ জন শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। সর্বোচ্চ সংখ্যক শিশু অর্থাৎ, ৫০ শতাংশ শিশু বন্যার কারণে অসুস্থ হয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থাৎ, ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিশু জলমগ্নতায় অসুস্থ এবং প্রচণ্ড খরার কারণে ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ শিশুর অসুস্থ হয়।
দুর্যোগে আক্রান্ত খানার আর্থিক সহায়তা প্রাকৃতিক দুর্যোগে উল্লিখত ছয় বছরে ৭৪ দশমিক ০২ শতাংশ খানা সরকার, ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ খানা এনজিও/আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। এছাড়া ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ খানা স্থানীয় ধনী ব্যক্তি/সমবায় সমিতি, ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ খানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ খানা অন্যান্য উৎস (আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতি) থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।
দুর্যোগে আক্রান্ত খানার সদস্যদের চিকিৎসা ব্যয় বিডিআরএস ২০২১ জরিপে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছয় বছরে অসুস্থ, আহত প্রভৃতিতে খানার ২৪ লাখ ১২ হাজার ৩৮৯ জন সদস্যের চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। মাথাপিছু গড় চিকিৎসা ব্যয় ১৬ হাজার ৩৪১ টাকা। যার মধ্যে ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৮ জন শিশুর মাথাপিছু গড় চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৮২১ টাকা।
বন্যায় ৬ বছরে ক্ষতি লাখ কোটি টাকা
পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততার কারণে রোগ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে পানযোগ্য পানির অপর্যাপ্ততা দেখা যায়, যে কারণে জরিপভুক্ত খানার ৪৪ দশমিক ১৪ শতাংশ সদস্য ডায়রিয়ায়, ২০ দশমিক ২২ শতাংশ আমাশয়, ঠান্ডা/সর্দি-কাশিতে ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, চর্মরোগে ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ আক্রান্ত হন। এছাড়া জ্বরে ২৩ দশমিক ৭০, জন্ডিসে ১১ দশমিক ১০ এবং ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হন।