মোঃ আব্দুল খালেক:শেয়ার ব্যবসায় সফলতা না পাওয়ার পেছনে অনেকে অনেক ভুল করে থাকেন। তার মধ্যে ৩০টি ভুল মোটামুটি প্রণিধানযোগ্য। ভুলগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. বিনিয়োগ যোগ্য সমস্ত টাকা বিও একাউন্টে ঢুকানো ভুল:আপনি যদি শেয়ার ব্যবসা করতে চান তাহলে আপনার হাতে থাকা অলস টাকার ৫০% আপনি শেয়ার বাজারে ঢুকাবেন। বাকি ৫০% ব্যাংক একাউন্টে রেখে দিবেন। যেন আপনার কেনা শেয়ারটির দাম কমে গেলে আপনি আবার পুনঃবিনিয়োগ করতে পারেন। এতে আপনার এভারেজ প্রাইস কমে আসবে এবং আপনি শেয়ারটি থেকে বের হতে পারবেন।
২. বিও হিসাবে জমা থাকা সমস্ত টাকা দিয়ে শেয়ার কেনা ভুল:শেয়ারের দাম বাড়লে যেমন গ্যাম্বলাররা বা মামারা আনন্দিত হয়, তেমনি দাম কমলেও তারা আনন্দিত হয়। তাদের হাতে সবসময় ক্রয়যোগ্য টাকা থাকে। কিন্তু আমরা ফ্রি টাকা রাখতে পারি না, এটা আমাদের বড় ভুল।
৩. এক ট্রেডে সমস্ত শেয়ার বাই করা ভুলঃ ধরুন আপনি পঞ্চাশ হাজার শেয়ার বাই করবেন, সেটার জন্য আপনার মাস্টার প্ল্যান থাকতে হবে। বারে বারে বাই না করে একবারে বা এক ট্রেডে পঞ্চাশ হাজার শেয়ার বাই করা মহা ভুল, যদি কোন সুনির্দিষ্ট নিউজ আপনার কাছে না থাকে।
৪. এক ট্রেডে সমস্ত শেয়ার সেল করা ভুলঃ আপট্রেন্ডের শেয়ার একবারে সেল না করে কয়েক ধাপে সেল করা উত্তম।
৫.প্রফিট আসলে আরো লাভের আসায় সেল না দিয়ে ধরে রাখা ভুলঃ প্রফিট আসলে কিছুই সেল না করে অধিক লাভের আসায় সব গুলো শেয়ার ধরে রাখা ভুল।
৬.পতনের শেষ না দেখে এভারেজ করা ভুলঃ বাই করা শেয়ারটি পড়ে যেতে লাগলে সাথে সাথে বাই করে এভারেজ করা ভুল। পড়ে যেতে লাগলে সাথে সাথে স্টপ লস দিতে হবে, না হলে পতনের শেষ দেখে এভারেজ করতে হবে।
৭. অতি লোভ করা ভুলঃকোন শেয়ার কয়েক দিন বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ দামে পৌঁছার পর সেল না করে আরো লাভের আসায় ঐ শেয়ার আরো বেশী করে বাই করা ভুল।
৮. পোর্টফলিওতে বিভিন্ন সেক্টরের শেয়ার না রাখা ভুলঃপোর্টফলিওতে এক সেক্টরের শেয়ার না রেখে কয়েক সেক্টরের সবচেয়ে ভালো এবং সম্ভাবনাময় শেয়ার দিয়ে পোর্টফলিও সাজাতে হবে।
৯. মাঝে মধ্যে সাইড লাইনে না থেকে সারা বছর হাতে শেয়ার রাখা ভুলঃ কিছু কিছু সময় মার্কেটের বাহিরে থাকতে হবে, যেমন ডিসেম্বর ক্লোজিং এবং জুন ক্লোজিং এর জন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণার মাস খানেক আগে, দুই মুদ্রানীতীর আগে, রমজান এবং কোরবানীর ঈদের আগে, ব্যাংক ক্লোজিং এর জন্য ডিসেম্বর এবং জুন মাস।
১০. শেয়ারের দাম কমে তলানীতে আসলে বাই না করে সেল করা ভুলঃ কোন খারাপ নিউজের কারণে শেয়ারটি কমে তলানীতে আসলে সেটা ধরে না রেখে অধৈর্য হয়ে সেল করা ভুল। তখনই শেয়ারটি বাই করার উত্তম সময়।
১১. কারেকশনের অপেক্ষায় না থেকে শেয়ার বাই করা ভুলঃকোন শেয়ার দুই তিন দিন বাড়ার পরে কারেকশনের অপেক্ষায় না থেকে সেটা বাই করা ভুল।
১২.গুজবে বিশ্বাস করা ভুলঃ গুজবের পিছনে দৌঁড়ানো বা পরের কথায় শেয়ার কেনা ভুল।
১৩. পোর্টফোলিওতে অধিক সংখ্যক শেয়ার রাখা ভুলঃ পোর্টফলিওতে ৫ এর অধিক শেয়ার রাখা ভুল।
১৪.মার্কেট ওপেন হওয়ার সাথে সাথে শেয়ার কেনা ভুলঃ কোন সুনির্দিষ্ট নিউজ ছাড়া মার্কেট ওপেন হওয়ার সাথে শেয়ার কেনা ভুল। সাধারণত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত মার্কেট স্লো থাকে তখন কম দামে শেয়ার পাওয়া যায়।
১৫. ডাইরেক্ট শেয়ার কেনা বড় ভুলঃ রেট বসায়ে শেয়ার কেনা উত্তম। কারণ কারো না কারো শেয়ার সেল করার জরুরী প্রয়োজন থাকে।
১৬. গোঁ ধরে থাকাভুল: গোঁ ধরে থাকা ভুল। যেমন আমি অমুক সেক্টোরের,বা অমুক কোম্পানী বা অমুক ক্যাটাগরির বা অমুক মালিকের শেয়ার কিনবো না ।
১৭. শেয়ার সেল করে সাথে সাথে শেয়ার কেনা ভুলঃ কোন সুনির্দিষ্ট নিউজ ছাড়া শেয়ার সেল করে সাথে সাথে শেয়ার কেনা ভুল। ৫দিন ১০দিন ১৫ দিন অপেক্ষা করলে অনেক ভালো ভালো সুযোগ পাওয়া যায়।
১৮.সিজন অনুযায়ী শেয়ার না কেনা ভুলঃআমাদের শেয়ারবাজারে দুটো সিজন আছে- যেমন জুন ক্লোজিং এবং ডিসেম্বর ক্লোজিং। সাধারণত থার্ড কোয়ার্টার ইপিএস ঘোষণার পর যে সমস্ত কোম্পানীর ইপিএস ভালো আসে, তাদের দাম বাড়তে থাকে তখন শেয়ার কিনলে লাভ করা যায়।
১৯. ব্যাক আপ শেয়ার পোর্টফলিওতে না রাখাভুলঃ মার্কেট ধ্বসে গেলেও যেসব শেয়ার খুব একটা কমে না এই জাতীয় শেয়ার পোর্টফোলিতে রাখা উত্তম। যেমন স্কয়ার ফার্মা, রেনেটা, মাল্টিন্যশনাল কিছু কোম্পানীর শেয়ার পোর্টফলিওতে না রাখা ভুল।
২০. লসে শেয়ার সেল করে নতুন শেয়ার বাই করা ভুল: এতে ইকুয়িটি কমে যায় যা রিকভার করা কঠিন হয়ে যায়। আবার দেখা যায় যেটা লসে সেল করা হয়েছে, সেটা কিছুদিন পরে বাড়তে শুরু করেছে। তখন আফসোস করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
২১. ঘন ঘন ট্রেড করা ভুল: এতে যেমন বার বার কমিশন কাটা যায় তেমনি একটায় লাভ হলে বাকি তিনটায় লস হয়। মনে রাখবেন শেয়ারবাজার থেকে লাভ করতে হলে বিনিয়োগকারী হতে হবে, ট্রেডার নয়। কারণ বিনিয়োগকারীর সাথে কখনই ডে ট্রেডার পারে না ।
২২. দ্রুত লাভের আসা করা ভুল: মনে রাখবেন রেকর্ড ডেটের পরে সর্বনিম্ন দামে শেয়ার কিনে ছয় মাস বা এক বছর অপেক্ষা করলে কখনও লস হবে না।
২৩. অতি আবেগপ্রবণ হওয়া ভুল: শেয়ার ব্যবসায় আবেগ পরিহার করে ধীরস্থির ঠান্ডা মাথায় বাই সেল করতে হবে।
২৪.সমস্ত টাকা এক শেয়ারে বিনিয়োগ করা ভুল:বাফেট বলেছেন দুই পা ডুবায়ে পানির গভীরতা মাপতে যাবেন না। সমস্ত ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না। কোন শেয়ার যদি সোনার ডিমও দেয়, তবুও সমস্ত টাকা এক শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না।
২৫. মার্কেটকে অধিক সময় না দেয়া ভুলঃমার্কেটকে অধিক সময় না দিয়ে ফেসবুকে অধিক সময় দেয়া বা অন্যের কথায় শেয়ার বাই সেল করা ভুল।
২৬.অনলাইন বা প্রিন্ট মিডিয়ার সব নিউজ বিশ্বাস করা ভুলঃ শেয়ারবাজার রিলেটেড অনলাইন পত্রিকা বা প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর সব নিউজকে অন্ধের মত বিশ্বাস করা ভুল। কারণ তারা কোনো কোনো সময় স্বার্থের বিনিময়ে নিউজ করে। তাই তাদের সব নিউজকে পজিটিভবা নেগেটিভ হিসাবে নেওয়া ভুল।
২৭. ধার করে মার্কেটে টাকা ঢুকানো ভুলঃ ধার দেনা করে এবং মার্জিন ঋণ নিয়ে মার্কেটে টাকা ঢুকানো ভুল।
২৮. ফেসবুকে পেইড ধান্দাবাজদের কথায় শেয়ার কেনা ভুলঃ কোন শেয়ারের অতীত ভবিষ্যৎ না জেনে বা শেয়ারটি সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে আইটেমবাজদের নিকট থেকে নাম শুনে শেয়ার কেনা ভুল।
২৯.গ্যাম্বলারদের সাইকোলজি বুঝতে না পারা ভুলঃ গ্যাম্বলাররা যে শেয়ারে গেম করে তাতে তারা নানান রকম কৌশল অবলম্বন করে। যেমন কখনও হল্টেড করে কখনও বায়ারলেস করে। কখনও বিগ ভলিউম করে, আবার কখনও লো ভলিউম করে। এগুলো না বুঝে একটু দাম বাড়তে দেখে বা একটু দাম কমতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে হঠাৎ করে হাতের সমস্ত শেয়ার সেল করা বড় ভুল।
৩০.শেয়ার ব্যবসা না বুঝে এই ব্যবসা করতে নামা ভুলঃ সর্বশেষ শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কে পুরোপুরি অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান অর্জন না করে এই ব্যবসায় ঢুকা বড় ভুল। ইপিএস, এনএভি, পিই রেশিও, ইপিএস গ্রোথ, ভালো কোম্পানী, খারাপ কোম্পানী, রিজার্ভ, ডিভিডেন্ড , ক্যাশ ডিভিডেন্ড, স্টক ডিভিডেন্ড, রাইট শেয়ার, প্রেফারেন্স শেয়ার, প্লেসমেন্ট শেয়ার, ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে।
ভুল গুলো পরিহার করে সঠিক পন্থা অবলম্বন করে বাই সেল করলে টাকা কামানোর মতো এতো সহজ জায়গা শেয়ারবাজার ছাড়া আর দ্বিতীয়টি নেই।
লেখক: একটি কলেজের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী