নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক ও কর্মকর্তা শিশুদের পড়ানো শিখতে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) প্রকল্পের আওতায় এই প্রশিক্ষণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৫৮৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, জনপ্রতি প্রায় ৩ লাখ টাকা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিদেশে শিক্ষার পরিবেশ দেখতে এত শিক্ষক-কর্মকর্তার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শিশুদের পড়ানো শিখতে কেন বিদেশ যেতে হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদি যেতেও হয় তাহলে এত কর্মকর্তা কেন।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন দেশে শিক্ষার পদ্ধতি ও পরিবেশ কেমন তা দেখতেই এই বিদেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও উন্নত ও শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় ৩৮ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পিইডিপি-৪ প্রকল্প জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পটির মূল অনুমোদনে এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ৪০ হাজার কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। করোনা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এখাতে ৫৭২ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আর ৪০ হাজারের জায়গায় প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে ২০ হাজার ২২৫ জনকে রাখা হয়েছে।
এদিকে ইতোমধ্যেই প্রায় ৮২০ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছেন বলে জানা গেছে। মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা এক শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, তারা সেখানে দুই-তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছেন। তারা শিক্ষা পদ্ধতি ও পরিবেশ দেখেছেন।
তারা জানান, সেখানে শিক্ষকদের যে ফ্যাসিলিটি দেওয়া হয় আমাদের এখানে সেটা দেওয়া হয় না। আমরা যা বেতন পাই তা সীমিত। তাই আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হয়; কিন্তু তাদের করতে হয় না। তাই তারা পুরোপুরি শিক্ষকতায় মনোযোগ দিতে পারেন। আমাদের বেতন-ভাতা তাদের মতো হলে শিক্ষার মান আরও ভালো হতো।
শিশুদের পড়ানো শিখতে কেন বিদেশ যেতে হবে জানতে চাইলে প্রকল্পটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত সচিব দিলীপ কুমার বণিক বলেন, মানসম্মত শিক্ষা ও মানসম্মত জ্ঞান অর্জনের জন্য, দক্ষতার জন্য তারা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন। টেকনোলজি, শিক্ষার পরিবেশ, বিদেশে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে দেশে প্রয়োগ করার জন্য যাবেন তারা। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তো যাওয়া প্রয়োজন।
দেশে তো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেই, তাহলে এত শিক্ষক কর্মকর্তাকে কেন বিদেশ পাঠাতে হবে। কিছু কর্মকর্তা বিদেশের শিক্ষার পরিবেশ ও মান বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিলেই তো হয়। এই বিষয়ে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তো শিক্ষক সাড়ে তিন লাখ। সব শিক্ষককে তো রাখিনি। মাত্র বিশ হাজার রেখেছি। যারা জেলা-উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হন তাদের মূলত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়ার জন্য বিদেশে এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তাদেরও তো একটু বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার আশা থাকে। উন্নত শিক্ষা নেবেন। তাই তাদের জন্য বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষকদের সমপর্যায়ের অন্যান্য বিভাগ থেকেও কর্মকর্তারা যাচ্ছেন।
শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে অনেক শর্ত দেওয়া থাকে। তারা কী শর্ত দিয়েছেন সেটা আমার জানা নেই। এই শর্ত না দেখে কিছু বলা যাবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই বিষয়ে বলেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা আয়েশ করতে যান। পড়াশোনা শেখানোর জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমার মনে হয় না। এছাড়া সরকার যখন বিদেশে প্রশিক্ষণ বন্ধ রেখে অর্থ সাশ্রয় করতে চাচ্ছে, সেখানে হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কতটা যৌক্তিকতা আছে, সেটি ভেবে দেখা দরকার।
এদিকে বিদেশি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এই প্রকল্পে দেশে প্রশিক্ষণেও রাখা হয়েছে ২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এই অর্থে দেশের ২ লাখ প্রাথমিকের শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেবেন। এক্ষেত্রে একেকজন শিক্ষককে দেশে প্রশিক্ষণ দিতে খরচ পড়বে ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, যা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে।
এই বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. উত্তম কুমার দাশ বলেন, আমাদের এবারের প্রকল্পই হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য। আমাদের সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তার মধ্যে ৬৫ হাজার প্রধান শিক্ষককে লিডারশিপ ট্রেইনিং দিতে হয়। ৬১ হাজার শিক্ষক নতুন জয়েন করবে তাদের ট্রেনিং দিতে হবে। শিক্ষক ছাড়াও অন্যান্য কর্মকর্তাকে ট্রেনিং দিতে হয়। তাই এ অর্থ আমাদের প্রয়োজন।
অন্যদিকে প্রকল্পটির আওতায় ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নলকূপ বসাতেই ব্যয় করা হচ্ছে ৪৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এখানে একেকটি নলকূপ নির্মাণেই খরচ করা হচ্ছে ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। যেখানে সমগ্র দেশে পানি সরবরাহ প্রকল্পে একেকটি নলকূপ বসাতে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ২৮ হাজার টাকা। গভীর নলকূপ স্থাপনেও খরচ লাখ টাকার বেশি হয় না। তাহলে এত টাকা লাগছে কেন?
এ প্রকল্পে নলকূপ নির্মাণ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকোশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকোশলী ড. সুশান্ত রায় বলেন, আমরা স্থাপন করব গভীর নলকূপ। এগুলোর সঙ্গে দেড় হর্স পাওয়ারের পাম্প থাকবে। ওপরে পানির ট্যাঙ্কি থাকবে। বেশ কয়েকটি পানির ট্যাপ থাকবে। সঙ্গে একটি বেসিনও থাকবে। এটি শুধু একটি নলকূপ নয়। এজন্য খরচও বেশি। এই নলকূপগুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে।
এদিকে এই প্রকল্পের আগের ধাপেও সারা দেশে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিউবয়েল নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, পিইডিপি-১ ও পিইডিপি-২ বাস্তবায়ন করেছিল এলজিইডি। সেই সময়ে স্থাপিত নলকূপগুলো এখন বেশিরভাগই অকেজো।
তিনি বলেন, আমরা পিইডিপি-৩-এ ৩৯ হাজার টিউবয়েল স্থাপন করেছিলাম, সেগুলো এখনও ফাংশনাল। দেশে স্কুলের সংখ্যা ৬৫ হাজার। বাকি যে নলকূপগুলো সেগুলো আগে করা হয়েছিল। এলজিইডির টিউবয়েল করার সক্ষমতা ছিল না। সেই টিউবয়েলগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার কারণে এ প্রকল্পে পাঁচ হাজার টিউবয়েল অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।