শাহ মো. সাইফুল ইসলাম : শেয়ারবাজারে লাভ যেমন বেশি, ঝুঁকিও তেমন বেশি। বিচার-বিশ্লেষণ না করে হুজুগে বিনিয়োগ করলে শেয়ারবাজারে ঝুঁকির সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। আর বিচার-বিশ্লেষণ করে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে হলেও লাভের সম্ভাবনাই বেশি। সেজন্য শেয়ার কেনার আগে আপনাকে অবশ্যই কিছু বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং দেশ-বিদেশের বাজারের অভিজ্ঞতার আলোকে শেয়ার ব্যবসায় আগ্রহীদের জন্য কিছু মৌলিক বিষয় তুলে ধরা হলো। তবে সব সময় যে এসব বিষয় কার্যকর ফল দেবে এমন নাও হতে পারে। বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদে কাঙ্খিত ফল পাওয়া মুশকিল হতে পারে। তবে বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বিনিয়োগ করা হলে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
** শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (P/E) : শেয়ারের পিই ২০ এর কম হওয়া ভালো। পিই রেশিও যত কম হয়, বিনিয়োগ ঝুঁকিও তত কম হয়। পিই রেশিও হচ্ছে একটি কোম্পানির শেয়ার তার আয়ের কতগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটি পরিমাপ। কোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় যদি ৫ টাকা হয়, আর বাজারে শেয়ারটির দাম থাকে ৫০ টাকা হয়, তাহলে শেয়ারটির মূল্য-আয় অনুপাত হবে ১০। এর অর্থ কোম্পানিটি যদি তার আয়ের পুরোটা ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করে দেয় তাহলে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে ১০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু শেয়ারটির বাজার মূল্য যদি হতো ১০০ টাকা, তাহলে মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই রেশিও দাঁড়াতো ২০। অর্থাৎ কোম্পানির আয়ের ধারা অপরিবর্তিত থাকলে বিনিয়োগ ফেরত পেতে ২০ বছর সময় প্রয়োজন হবে।
** শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV) : সম্পদ মূল্যের সাথে শেয়ারের বাজারমূল্যের একটা সামঞ্জস্য থাকা উচিত। যদিও কোম্পানির অবসায়ন (বিলুপ্তি) না হলে সম্পদ মূল্যে বিনিয়োগকারীর কার্যত তেমন কাজে আসে না। তবে কোম্পানির জন্য সম্পদ মূল্য খুব প্রয়োজনীয়। সম্পদ মূল্য কোম্পানিকে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা এনে দেয়। বিশেষ করে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেতে সম্পদ মূল্য কোম্পানির জন্য অন্যতম নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। আবার ফেসভ্যালুর দিক থেকেও সম্পদ মূল্য কোম্পানিকি বিশেষ মর্যাদা বা অবস্থানের আসনে অভিসিক্ত করে।
সম্পদ মূল্য শেয়ার মূল্যের কাছাকাছি হলে ভালো হয়। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলেন, শেয়ার মূল্য কোনোভাবেই সম্পদ মূল্যের দ্বিগুণের বেশি হওয়া উচিত নয়। দ্বিগুণের বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়। তবে শেয়ার মূল্য সম্পদ মূল্যের নিচে হলে খুব ভালো হয়।
** শেয়ারপ্রতি আয় (EPS) : ইপিএস যত বেশি হবে, ততই ভালো। ইপিএস বেশি হলে বিনিয়োগকগারীদের বেশি ডিভিডেন্ড দেওয়ার সুযোগ থাকে। ইপিএস কম হলে কোম্পানির ডিভিডেন্ড দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর ইপিএস বেশি হওয়া মানে কোম্পানির ভালো ব্যবসা। কোম্পানির ভালো ব্যবসা না হলে ইপিএস ভালো হয় না। ইপিএসের যদি প্রবৃ্দ্ধি থাকে, তাহলে তা খুব ভালো। যা কোম্পানিটির শক্ত ভবিষ্যত নির্দেশ করে ।
** রিজার্ভ : শেয়ার কেনার সময় অবশ্যই কোম্পানির রিজার্ভের অবস্থা দেখতে হবে। যে কোম্পানির রিজার্ভ ভালো, সেই কোম্পানি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও বিনিয়োগকারীদের ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। অর্থাৎ ভালো রিজার্ভ থাকলে কোম্পানির ভিত্তি মজবুত থাকে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কোম্পানির শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারে এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ক্ষমতা থাকে। সাধারণত রিজার্ভ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের দ্বিগুণের বেশি থাকা ভালো মনে করা হয়। তবে রিজার্ভ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৫-৬ গুণের বেশি হওয়া উচিত নয়। কারণ রিজার্ভ অত্যধিক বেশি হলে কোম্পানি স্বেচ্চাচারিতার দিকে অগ্রসর হতে পারে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা।
** মোট শেয়ার : শেয়ার কেনার আগে কোম্পানির মোট শেয়ার দেখতে হবে। পাশাপাশি দেখতে হবে কোম্পানিটির ফ্লোটিং শেয়ার বা লেনদেনযোগ্য শেয়ার কতটুকু। চাহিদা-যোগানের সূত্র অনুসারে শেয়ার সংখ্যা কম হলে তার মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অন্যদিকে শেয়ার সংখ্যা বেশি হলে বাজারে শেয়ারের ফ্লো বা সরবরাহ বেশি থাকে। এছাড়া নিয়মিত ভালো অঙ্কের লেনদেন হয় এমন শেয়ার কেনা ভালো। কারণ কোনো কারণে জরুরী ভিত্তিতে টাকার প্রয়োজন হলে সহজেই শেয়ার বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু নিয়মিত লেনদেন হয় না এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করা হলে জরুরিভিত্তিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহার সম্ভব নয়।
** অনুমোদিত মূলধন (authorized capital) ও পরিশোধিত মূলধন (paid-up capital) : শেয়ার কেনার সময়ে অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন দেখতে হবে। এই দুই মূলধনের পরিমাণ কাছাকাছি থাকলে বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিকে আগে অনুমোদিত মূলধন বাড়াতে হবে। বোনাস ডিভিডেন্ডে যেসব বিনিয়োগকারীর বিশেষ ঝোঁক রয়েছে তাদের উচিত এসব বিষয় দেখা নেওয়া।
** ডিভিডেন্ড ঈল্ড : শেয়ারের বাজার মূল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই ডিভিডেন্ড হার প্রকৃত রিটার্ন নির্দেশ করে না। ডিভিডেন্ড ঈল্ডই শেয়ারের সঠিক রিটার্ন। বাজার মূল্যের ভিত্তিতে প্রাপ্য ডিভিডেন্ড বিনিয়োগের কত শতাংশ তা-ই হচ্ছে ডিভিডেন্ড ইল্ড। ঘোষিত ডিভিডেন্ডকে ১০০ দিয়ে গুণ করে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে ভাগ করলে ডিভিডেন্ড ইল্ড পাওয়া যায়। ডিভিডেন্ড ইল্ড যত বেশি হবে বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্তিও তত বাড়বে।
** ৪-৫ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড : গত ৪-৫ বছরে কী পরিমাণ ডিভিডেন্ড দিয়েছে তা দেখুন। বার্ষিক গড় মূল্য দেখুন। চেষ্টা করুন এই মূল্যের কাছাকাছি দামে শেয়ার কেনার।
মনে রাখতে হবে, বিক্রির সময় নয়, বরং কেনার সময়ই লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ভালো দামে শেয়ার কিনতে পারলে ভালো লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। কেনার সময় দাম বেশি পড়ে গেলে লাভের সম্ভাবনা একটু হলেও কমে আসবে।