নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ার ব্যবসায় বিংশ শতাব্দীর সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচিত ওয়ারেন বাফেট বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। সেসব পরামর্শ চাইলে আপনিও আপনার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন। ওয়ারেন বাফেটের ১৬টি পরামর্শ তুলে ধরা হলো, যা বিনিয়োগকারীদের কাজে আসতে পারে-
১. লাভ পুনরায় বিনিয়োগ করুন: যখন আপনি শেয়ার মার্কেটের প্রথম বিনিয়োগ থেকে মুনাফা করবেন তখন সেটা আবার পুনরায় সেখানেই বিনিয়োগ করুন। উদাহরনস্বরূপ ওয়ারেন বাফেট বলেন: হাইস্কুলে পড়ার সময় বাফেট এবং তার বন্ধুরা মিলে একটি পিনবল (একধরনের খেলা) মেশিন কিনে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় তাদের লাভ হয়। সেই লাভ তারা ভোগ না করে ঐ অর্থ দিয়ে আরও চারটি মেশিন কিনলেন। অর্থাৎ তারা ব্যবসা পাঁচগুন করে ফেলেন। আপনাকেও ব্যবসা বৃদ্ধি করতে হলে শুরুতেই লাভ ভোগ করা যাবে না। কেননা, এই ক্ষুদ্র অঙ্কের সমষ্টিই আপনাকে বিরাট সম্পদের অধিকারী করে তুলবে।
২. সবার সাথে তাল মেলাবেন না: সবাই যা করছে আপনিও ঠিক তাই করলে চলবেনা। আপনাকে হতে হবে ব্যতিক্রম। মার্কেটে সবাই যখন শেয়ার বিক্রি করছে তাদের দেখাদেখি আপনিও শেয়ার বিক্রি করলে দেখলেন যে দাম পড়ে গেছে। আবার যখন সবাই পাগলের মতো শেয়ার কেনা শুরু করেছে, তখন আপনি কিনতে গিয়ে দেখলেন যে, দামতো আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু বাফেট সবসময় সেইসব ভালো কোম্পানি খুঁজে বের করতেন, যেগুলোর দিকে অন্যদের এখনো দৃষ্টি পড়েনি, পাশাপাশি সেই ভালো শেয়ারগুলো যা বিক্রয় চাপের কারণে পানির দরে চলে এসেছে। এমন শেয়ার কিনলেই আপনি ক্ষতির মূখে পড়বেন না।।
৩. সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত: কোন কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হলে যে পরিমাণ তথ্য এবং বিশ্লেষণ দরকার তা দ্রুত শেষ করেই আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন। মনে করুন, আপনি কোনো শেয়ার কিনতে চাচ্ছেন কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য বা যে পরিমান বিশ্লেষণ করা দরকার তা করতে পারছেন না, তাহলে এমন শেয়ার কেনার চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য শেয়ার নিয়ে ভাবুন। অন্য কোনো সেক্টর কিংবা অন্য কোনো শেয়ারের পর্যাপ্ত তথ্য থাকলে তাই কিনুন। তবে সিদ্ধান্ত হিনতায় শেয়ার কিনবেন না।
৪. ব্রোকারেজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত: ব্রোকারেজ হাউজে অ্যাকাউন্ট খোলার আগেই আপনাকে সব বিষয় জেনে বুঝে নিতে হবে। যে ব্রোকারে অ্যাকাউন্ট খুলবেন তারা কমিশন কত নিবে, আপনি কি সুযোগ সুবিধা পাবেন, মার্জিন কত ইত্যাদি বিষয়াদি। অ্যাকাউন্ট আগে খুলে পরে হতাশ হওয়ার কোনো মানে নেই। ঠিক শেয়ার কেনার আগেও সবকিছু জেনেই কিনুন।
৫. ট্রেড কমাতে হবে: যারাই শেয়ার মার্কেট ভালো বুঝেন তারা অতিমাত্রায় ট্রেড করে। ফলে যা মুনাফা করছে তার বেশিরভাগই কমিশন আর মার্জিন লোন শোধ করতেই শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া গাড়ি ভাড়া ব্যয়ে সিএনজিতে করে ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে ট্রেড করার তো কোনো মানে নেই। এখন ঘরে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করেই ট্রেড করা সম্ভব। এতে যেমন অর্থের অপচয় হবেনা, তেমনি সময়ও বাঁচবে।
৬.ঋণ থেকে সাবধান: ঋণ করা টাকা হচ্ছে একটি বন্ধুত্ব সম্পর্ককে ভেঙ্গে দেওয়ার সহজ উপায়। ঋণ করে ব্যবসা করে তেমন মুনাফা করা যায়না। কেননা যা রোজগার হবে তা ধার শোধ করতেই ব্যয় হয়ে যাবে। ফলে জীবন ও অগোছালো হয়ে পড়বে।তাছাড়া বন্ধু, কিংবা আত্মীয় অথবা মার্জিন লোন নিয়ে শেয়ার ব্যবসা করা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ওয়ারেন বাফেট জীবনে কখনো কারও কাছ থেকে ধার নিয়ে ব্যবসা করেননি। তাঁর উপদেশ হচ্ছে- খরচ কমান আর সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ করুন।
৭. ধৈর্য্যশীল হতে হবে: ধৈর্য্য এবং নিষ্ঠার সাথে যেকোনো কিছু করলে তা থেকে একটু দেরিতে হলেও সাফল্য আসবেই। সফল শেয়ার ব্যবসায়ী হওয়া খুব সহজ নয়। আপনাকে কোম্পানি এবং সেক্টর বুঝতে হবে। একদিনেই সব হবেনা। কিন্তু আজ থেকে যদি চেষ্টা করেন তবে এক পর্যায়ে দেখবেন অনেক কিছুই হাতের নাগালে চলে এসেছে।
৮. সময় বুঝে হাল ছাড়তে হবে: বিফল কিছুর পিছনে একনাগারে লেগে থাকবেন না। একটি কোম্পানি যদি বছরের পর বছর খারাপ পারফর্ম করে তাহলে তা নিয়ে বসে থাকার কোনো মানে নেই। লোকসান গোনা বন্ধ করতে শিখুন। বেঁচে যাওয়া এই টাকা বরং অন্য কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন।
৯. ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করুর: শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কতটা লোকসান সহ্য করতে পারবেন এটা আপনি জানেন। আপনার ক্ষেত্রে সেটা কত? ১০ হাজার নাকি ১ লাখ নাকি ১০ লাখ নাকি ১ কোটি। নিজের ক্ষমতার বাইরে ঝুঁকি নিয়ে আপনি লাভবানও হতে পারেন কিন্তু লস করলে পথে বসে যাবেন। তাই ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করুন এবং তা অবশ্যই মেনে চলুন।
১০.সাফল্যের অর্থ বুঝতে হবে: সাফল্যের মানে কি শুধুই টাকা নয়। একজন মানুষের জীবনে টাকা ছাড়া অনেক কিছু আছে- পরিবার, ক্যারিয়ার, সম্মান ইত্যাদি। বাকি সবকিছু ধরে রেখে আপনার কত টাকা হলে চলবে তা কখনো চিন্তা করেছেন? অতিরিক্ত টাকার পেছনে ছুটে আমরা অনেকেই জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলি। প্লীজ, এটা কখনোই করবেন না। তাহলে জীবনের রংটাই বদলে যাবে।
১১. স্টক বিনিয়োগের দিকে দৃষ্টি রাখুন: আপনার ব্যবসার অংশ হিসেবে স্টক বিনিয়োগের দিকে দৃষ্টি রাখুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, ‘আপনি কেমন বোধ করবেন, যদি আগামীকাল থেকে আগামী তিন বছরের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে আপনি কি বন্ধ রাখলে খুশি না কি এ ব্যবসার সঙ্গে থেকে আপনি আনন্দ বোধ করছেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের মানসিক কাঠামো গঠন করা অত্যন্ত জরুরী।
১২. মার্কেট আপনাকে সেবা দেবে নির্দেশনা নয়: এই মার্কেট আপনাকে সেবা দিচ্ছে কিন্ত কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে না। আপনি কি সঠিক না ভুল এটা আপনাকে বলবে না। ব্যবসার ফলাফলের ওপর এটা নির্ধারণ করবে। তাই নিজেকে সফল করার জন্য চোখ কান খোলা রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
১৩. মার্জিন ঋণ পরিহার: একটি শেয়ারের মূল্য আপনি অবিকল জানতে পারবেন না। সুতরাং বিনিয়োগ নিরাপদ রাখতে হলে মার্জিন ঋণ পরিহার করুন। তাহলে আপনি যে শেয়ারে ঢুকবেন তা ভুল ভুল হলে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
১৪. আবেগে বিনিয়োগ নয়: শেয়ার জানেনা আপনি এটার মালিক। কেননা আপনার এটা সম্বন্ধে অনুভূতি থাকলেও এটার কিন্তু আপনার সম্বন্ধে কোনো অনুভূতি নেই। শেয়ার জানেনা, আপনি এখানে কত অর্থ প্রদান করেছেন। তাই আবেগের বশীভূত হয়ে এখানে বিনিয়োগ করা একদমই উচিত নয়।
১৫. হিসাব করে ব্যয়: উর্পাজন প্রসঙ্গে- কখনো একমাত্র আয়ের উৎসের ওপর নির্ভরশীল হবেন না। দ্বিতীয় আয়ের নতুন উৎস তৈরির জন্য বিনিয়োগ করুন। ব্যয়ের ক্ষেত্রে- আপনি যদি এমন কিছু কেনেন যা আপনার দরকার নাই, তাহলে শিগগিরই ( দৈনন্দিন খরচ মেটাতে) আপনার দরকারি জিনিসপত্র বিক্রি করে দিতে হবে। তাই হিসাব করে ব্যয় করতে শিখুন।
১৬. সবগুলো ডিম একই ঝুঁড়িতে রাখবেন না: সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে- খরচ করে যেটুকু বাকি থাকে তা থেকে সঞ্চয় না করে বরং সঞ্চয় করে যা থাকে সেখান থেকেই খরচ করুন। ঝুঁকি নেওয়ার সময়- কখনোই উভয় পা পানিতে রেখে নদীর গভীরতা পরিমাপ করতে যাবেন না। অর্থাৎ সব সময় কিছু সম্বল রেখে দিবেন। পুরোটাই ঝুঁকি নেওয়ার জন্য ব্যবহার করবেন না। বিনিয়োগের জন্য- সবগুলো ডিম একই ঝুড়ির মধ্যে নেবেন না। অর্থাৎ একটি মাত্র ক্ষেত্রে বিনিয়োগ না করে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করুন, যাতে মূলধন হারানোর ঝুঁকি কম থাকে।