নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বাজার মূল্যে নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। যদিও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগক ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা নিয়ে বাজার বিশ্লেষকরা ওইদিনই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এরমধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী তাৎক্ষনিকভাবে নির্দেশনাটিকে ভালো বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্দেশনাটির ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে অন্যান্য বিশ্লেষকদের মধ্যে বেশিরভাগই বলেছিলেন, নির্দেশনাটি নেতিবাচক। এটি বাজার আরও খারাপ করবে।
নির্দেশনাটি জারি করার পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) শেয়ারবাজারে মিশ্র প্রবণতায় লেনদেন হয়। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর সব সূচক প্রথমভাগে বেশ ইতিবাচক থাকলেও শেষদিকে নেতিবাচক প্রবণতায় মোড় নেয়। দিনশেষে সূচক কোনো রকমে ইতিবাচক রাখা হলেও বেশিরভাগ সিকিউরিটিজের দর ছিল নেতিবাচক।
তার পরেরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার উভয় বাজারে বড় পতন দেখা দেয়। এদিন লেনদেনের প্রায় ৭০ শতাংশ সিকিউরিটিজই ছিল পতন প্রবণতায়। ডিএসইর ২০ খাতের মধ্যে ওইদিন দুই-তিন খাতে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী আলোতে থাকলেও সিংহভাগই অন্ধকারে ডুবে যায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ভর করে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের ক্রয়মূল্যে গণনা করার দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানো হয়েছে। যার ফলে বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশি বন্ডের মতো ডেভ সিকিউরিটিজ, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইনভেস্টমেন্ট এক্সপোজার বা বিনিয়োগ গণনা বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনাতেও বিনিয়োগ গণনা ক্রয় মূল্যের পরিবর্তে বাজারমূল্যে ধরার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ডের মতো ডেভ সিকিউরিটিজ, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রয়ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাটি শেয়ারবাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। বন্ড হলো একটা ডেভ ইনুস্টুমেন্ট, এটা ইক্যুইটি না। এটা এক্সপোজারে কীভাবে আসে? দ্বিতীয়ত মিউচ্যুয়াল ফান্ড কোনো শেয়ার না, এটা একটি ইউনিট। এটা কীভাবে এক্সপোজারে আসে। আবার আমরা বারবার বলেছি এক্সপোজার গণনা ক্রয়মূল্যে বিবেচনা করার জন্য, কিন্তু ওনারা বাজারমূল্যই ধরে রেখেছেন। এই নির্দেশনাটা সম্পূর্ণ নেতিবাচক।
তিনি বলেন, নির্দেশনায় আর একটা কথা বলা হয়েছে সাবসিডারি কোম্পানিকে যে ইক্যুইটি দেওয়া হয়েছে তা ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এটা নতুন কিছু না। আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থাতেই এটার সমাধান হয়েছে।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক শেয়ারনিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে ফের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি আশঙ্কা করে বলেন, বাজার আরও বেশি খারাপের দিকে যেতে পারে। কারণ আমরা বারবার বলেছি ইনভেস্টমেন্ট এক্সপোজার ক্রয়মূল্যে বিবেচনা করার জন্য। কিন্তু ওনারা বাজারমূল্যই ধরে রেখেছেন। এই নির্দেশনা উদ্দেশ্যমূলক। যা বাজারের জন্য অশুভ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারকে নিয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়ার কথা রয়েছে। যাতে কোনো সিদ্ধান্ত বাজারের বিপরীতে না যায়। বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সবের কোন আমলই দিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের খামখেয়ালীর কারণে বিনিয়োগকারীরা বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণ করা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সকল প্রকার শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং শেয়ারবাজারের অন্যান্য নিদর্শনপত্রের বাজারমূল্য বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহকে দেওয়া ইকুয়িটি, দীর্ঘমেয়াদি ইকুয়িটি বিনিয়োগ/ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি (বিডি) ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর শেয়ার ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না।
এতে আরও বলা হয়, শেয়ারবাজারে কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত অপর কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিগুলোর অথবা কোনো স্টক ডিলারকে প্রদত্ত ঋণের স্থিতি ও তাদের সঙ্গে রক্ষিত তহবিলের স্থিতি (প্লেসমেন্ট বা অন্য যে নামেই অভিহিত করা হউক না কেন) বিনিয়োগসীমার বাইরে থাকবে।