মো. হাবিবুর রহমান: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যখন একের পর এক সূচকের রেকর্ড পতন হচ্ছিলো, ঠিক তখন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পতনরোধে তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর প্রেক্ষিতে পতনের বৃত্ত থেকে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসে শেয়ারবাজার। এতে করে বাজার ঘুরে দাঁড়ায় এবং সিকিউরিটিজের শেয়ারদর ও লেনদেনে গতি ফিরে আসে। এই পর্যায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হলেও ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার নিয়ে রয়েছে বাজার বিশ্লেষকদের নানা মত।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর কাছে অর্থ পড়ে আছে, যা তারা বিনিয়োগ করে বাজারকে সার্পোর্ট দিতে পারে। এতে করে বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে যে অস্থিরতা রয়েছে তা কেটে যাবে। এছাড়াও ব্যাংকগুলোকে বন্ড ছাড় দেওয়ার বিষয়ে বিএসইসির যে সাহসী পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে, তা ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উৎসাহ যোগাবে।
অন্যদিকে, মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর কাছে যে অর্থ পড়ে আছে সে অর্থ বিনিয়োগ করলেও বাজার অনেক বেশি সাপোর্ট পাবে। বাজারকে সাপোর্টদেওয়ার জন্য এই বিষয়গুলো নিয়ে বিএসইসি প্রশংসিত হলেও ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার নিয়ে রয়েছে দ্বিমত।
গেলো কয়েক দিনে বিএসইসি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাজারের জন্য কি পরিমাণ সাপোর্টদিবে এমন প্রশ্নের জবাবে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ারনিউজকে বলেন, ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের জন্য যে ফান্ড গঠন করেছে সেগুলো তারা আগেই বিনিয়োগ করেছে। যারা ফান্ড গঠন করেনি তাদের বিষয়টি আলাদা। কিন্তু মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো কোথা থেকে বাজারে বিনিয়োগ করবে। তাদের কাছে তো অর্থ নেই।
তিনি আরও বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো বাজারের জন্য কখনোই ভালো কিছু করতে পারেনি। ফান্ডগুলোর বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা নেই। গত ১০ থেকে ১২ বছর যাবত শেয়ারবাজারে এমনটাই লক্ষ্য করা গেছে।
আবু আহমেদ বলেন, বিএসইসি সার্কিট ব্রেকার নিয়ে ২ শতাংশের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা পৃথিবীর কোথাও নেই। এসব করে আসলে বাজারকে স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত বাজারের রুলসের বাইরে গিয়ে পরিপালন করা হচ্ছে। বরং বাজারকে তার নিজের গতিতে চলতে দেওয়া উচিৎ। বাজারের ভালো ভালো কোম্পানি না আসলে বাজারে স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়।
বিষয়টি নিয়ে এএফসি ক্যাপিটালের সিইও মাহবুব এইচ মজুমদার শেয়ারনিউজকে বলেন, বিএসইসি বাজারে স্থিতিশীল করার জন্য তাৎক্ষণিক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সময় উপযোগী। ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিয়োগের বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়া বা উৎসাহ দেওয়া, মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উৎসাহ দেওয়া খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। এই সমস্ত সিদ্ধান্ত বাজারের জন্য খুবই পজেটিভ।
তিনি আরও বলেন, ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার পৃথিবীর কোন বাজারে নেই। আমাদের দেশের এটি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। বাজারের অতিরিক্ত পতন ঠেকানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। যা সময়িক ভালো হলেও এটি যেন বেশি দিন না থাকে। কারণ বাজারের সাথে এমন সিদ্ধান্ত যায় না। এই সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরে তুলে দিলেই বাজারের জন্য ভালো হবে
তবে ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার করার সময় বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদও বলেছেন, সার্কিট ব্রেকারের এই পরিবর্তন সাময়িকভাবে করা হয়েছে। বাজারের পরিস্থিতির আলোকে এটা তুলে দেওয়া হবে।
এর আগে, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বাজারের অতিরিক্ত পতন ঠেকাতে নতুন করে সার্কিট ব্রেকারের ঘোষণা দেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ বাড়তে পারবে ১০ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ কমতে পারবে ২ শতাংশ।
এছাড়াও স্ট্যাবলাইজেশন ফান্ড থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য আইসিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইসিবি ইত্যোমধ্যে এই বিনিয়োগ শুরু করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যে ২০০ কোটি টাকা করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা রয়েছে, বর্তমানে তা বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ দিয়েছে। যে সকল ব্যাংক এখনও ফান্ড গঠন করেনি, তাদেরকে ফান্ড গঠন করার জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানান তিনি। এজন্য তিনি বিএসইসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে ধন্যবাদ জানান।
এরই প্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর সাথে পরের দিনই বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ব্যাংগুলোর চীফ ফাইন্যান্স অফিসাররা (সিএফও) বিএসইসির সাথে তিনটি বিষয়ে একমত হয়েছে। সিদ্ধান্ত তিনটির মধ্যে ব্যাংগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সীমা রয়েছে ২৫ শতাংশ। যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ ২৫ শতাংশের কম রয়েছে, তারা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ২ শতাংশ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর ২০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করার কথা রয়েছে। যেসব ব্যাংক এখনও ফান্ড গঠন করেনি, সেসব ব্যাংক দ্রুত ফান্ড গঠন করবে। আর যারা ফান্ড গঠন করেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য যতটুকু সাপোর্ট প্রয়োজন ব্যাংকগুলো সেই পরিমাণ বিনিয়োগ করবে।
ট্রায়াল-১ এবং ট্রায়াল-২ ক্যাপিটাল হিসেবে যে সকল ব্যাংক পারপেচ্যুয়াল বন্ড এবং সাব অর্ডিনেন্ড বন্ড ইস্যুর জন্য আবেদন করবে, সেগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুমোদন দেয়া হবে। ব্যাংকের যে সকল বিষয় ক্যাপিটাল রাইজিংয়ের সাথে জড়িত, সেগুলোও দ্রুত অনুমোদন দেয়া হবে।
এর পরের দিন (১০ মার্চ) বৃহস্পতিবার বাজারে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টদের সাথে বৈঠকে বসছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টগুলোর সাথেও তিনটি বিষয়ে একমত হয়েছে কমিশন।
সিদ্ধান্ত তিনটির মধ্যে রয়েছে: অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টগুলোর ফান্ডের কাছে যে অলস অর্থ রয়েছে, তা তারা বাজারে বিনিয়োগ করবে। বর্তমানে যে সকল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ লাভজনক অবস্থানে রয়েছে, সেগুলোতে তারা বিনিয়োগ করবে। আর ব্যাংক ইন্স্যুরেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তারা ফান্ড ম্যানেজ করবে। আর সেই ফান্ড বাজারে বিনিয়োগ করবে। এর আগে বিএসইসির কাছে ব্যাংকগুলোর সিএফও’রাও অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টগুলোকে ফান্ড দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।