নিজস্ব প্রতিবেদক : আর্থিক খাতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত পি কে হালদারের দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের নেপথ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে বলে দুর্নীতি কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতে তাঁর দুর্দান্ত প্রতাপ ও একচ্ছত্র ক্ষমতার উৎস ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় তিন কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, পি কে হালদারের অবিশ্বাস্য জালিয়াতিতে পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। এখন পর্যন্ত তিনি আড়ালেই আছেন। সহযোগী হিসেবে আরও একজন ব্যবসায়ী ও সাবেক একজন অ্যাটর্নি জেনারেলের (প্রয়াত) নামও জানতে পেরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই রাঘববোয়ালকে খুঁজে বের করতে দুদকের তদন্ত অব্যাহত আছে।
এদিকে, কলকাতা থেকে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর দুর্নীতির মূল সহযোগীদের মুখোশ উন্মোচন করতে চায় দুদক।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি ও দুদকের ৩৫ মামলার আসামি পি কে হালদারকে গত ১৪ মে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। তিনি ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে ওই ৩৫ মামলায়।
দুদকের তদন্তে পি কে হালদারের একচ্ছত্র ক্ষমতার উৎস হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর, এস এম মনিরুজ্জামান ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের নাম উঠে এসেছে।
ভারতীয় গোয়েন্দারা ইতোমধ্যে জানিয়েছে, পি কে হালদার ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর দুর্নীতির নেপথ্যে থাকা কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। দুদক আইনি প্রক্রিয়ায় ভারত সরকারের কাছ থেকে তাঁর ওই জবানবন্দি সংগ্রহ করবে বলে জানিয়েছে।
এদিকে, দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় যত দ্রুত সম্ভব ভারত থেকে পি কে হালদারকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পি কে হালদারের দুর্নীতির পেছনে যাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। তাঁরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিবকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, এই দুর্নীতির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে, তারপরও তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না, জবাবে ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, তাঁদের দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাঁদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
এর আগে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পি কে হালদারের ক্ষমতার উৎস হিসেবে এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম উল্লেখ করেছেন। জবানবন্দিতে পি কে হালদারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ওই দুই কর্মকর্তার সখ্য ও দুর্নীতিতে যোগসাজশ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এই এমডি জানান, সর্বদাই তাঁদের সুনজর ছিল পি কে হালদারের প্রতি। এর বিনিময় মূল্যও ছিল অনেক। একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনার সময় ওই দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের ঘটনার সময় শাহ আলম বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিএফআইএম (ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড মার্কেটিং) বিভাগের জিএমের দায়িত্বে ছিলেন। পরে তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান।
তিনি জানান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে শাহ আলমকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা দেওয়া হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ থেকে ইন্টারন্যাশাল লিজিংয়ের কার্যক্রম বছরে দু'বার নিরীক্ষা হতো। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সেই রিপোর্ট নিজের মতো তৈরি করিয়ে নিতেন পি কে হালদার।
তিনি আরও জানান, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমকে প্রতিবারই ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে অডিট টিম ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিল। ২০১১ সালে পি কে হালদার রিলায়েন্সের এমডি ছিলেন। মূলত ওই সময় থেকেই তাঁর অপকর্ম শুরু হয়। তিনি ইচ্ছামতো গ্রাহকদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই এক দিনের মধ্যে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করানোর ব্যবস্থা করে আত্মসাৎ করতেন। অনেক সময় গ্রাহক জানতেনও না যে তাঁর নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এভাবে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাৎ করেন।