নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। আর এসবের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় খুচরা সিগারেট বিক্রিকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের ধূমপানের আসক্ত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর খুচরা বিক্রির সুযোগ। ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে এরই মধ্যে বিশ্বের ১১৮টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে শলাকা আকারে সিগারেটের খুচরা বিক্রি।
এবার বাংলাদেশেও এই উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ওয়েবসাইটে এই ব্যাপারে উন্মুক্ত মতামত নেয়া হয়। চলতি বছরই এই সংক্রান্ত বিধিমালা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেসব দেশে খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও- এর ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল এফসিটিসি এর তথ্য অনুযায়ী, উত্তর আমেরিকার ৮টি দেশে, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে, আফ্রিকার ১৫টি দেশে, মধ্যপ্রাচ্যের ১৪টি দেশে, এশিয়ার ১৭ টি দেশে এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের ১০টি দেশে খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুসারে, সাড়ে ৪ কোটি তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারীর মধ্যে ৩৫ শতাংশই ১৫ বছর বয়সী বার তার কিছু বেশি। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার ২৪ শতাংশ।
বিশ্বে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
তামাকের ব্যবহারে বছরে মারা যায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ অনুযায়ী, তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া ধূমপানের কারণে বাংলাদেশে ১২ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হন।
অপরদিকে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগেছেন এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্যের ওপর তামাক ও ধূমপানের প্রভাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখগহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।
তামাকজনিত কারণে বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানোসহ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা ওই বছরের জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ একইসময়ে তামাকখাত থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ প্রত্যক্ষ ব্যয় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং তামাক ব্যবহারের ফলে অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতি ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অপরদিকে পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতি তামাকজনিত মোট আর্থিক ক্ষতির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
খুচরা সিগারেট বিক্রিতে বিপুল রাজস্ব ফাঁকি বর্তমানে প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত সর্বোচ্চ দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সিগারেট ও বিড়ি। এতে সরকার প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিইআর ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসির ‘তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা ও পাইকারি বিক্রয়মূল্যে জাতীয় বাজেটে মূল্য ও কর পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়, প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত সর্বোচ্চ দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করে বছরের পর বছর বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। এই গবেষণার সুপারিশেও সিগারেট ও বিড়ির খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
ধূমপানে আসক্তি কমাবে খুচরা সিগারেট বিক্রির আইন গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ব্যবহারকারী একজন ধূমপায়ী সিগারেট কেনা ও ব্যবহার করার সময় দিনে কমপক্ষে ২০ বার, বছরে ৭ হাজার বার সিগারেটের প্যাকেটে ছাপানো ছবি দেখে থাকে। অথচ তামাকজাত পণ্য যখন খুচরা শলাকা বা খোলা হিসেবে বিক্রি হয়, তখন স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখা যায় না। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।