নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ধানের কুঁড়ার তেল উৎপাদনকারী খাদ্য এবং আনুষাঙ্গিক খাতের কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলের কমেছে উৎপাদন। কোম্পানিটি সম্পুর্ণ গ্যাস এবং বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। গত কয়েক মাস ধরে গ্যাস এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে উৎপাদন কমেছে কোম্পানিটির। ঠিক এমন সময়েই কোম্পানিটি জাপানে তেল রপ্তানি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অফিস নিয়েছে বলেও ডিএসইতে তথ্য দিয়েছে কোম্পানিটি।
তেল রপ্তানির বিষয়ে কোম্পানিটির সচিবের সাথে যোগাযোগ করে শেয়ারনিউজ২৪.কম। কোম্পানি সচিব সাদিয়া আফরিন শেয়ারনিউজ২৪.কমকে বলেন, আমাদের কোম্পানি তেল রপ্তানির জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। কবে থেকে তেল রপ্তানি শুরু করবে তা এখনও ঠিক হয়নি।
এরই মধ্যে বিদ্যুও ও গ্যাসের সমস্যার কারণে কোম্পানিটির উৎপাদন কমেছে। কবে উৎপাদন স্বাভাবিক হবে তারও কোন ঠিক নেই। সে চিন্তা না করেই কোম্পানিটি জাপানে অফিসও নিয়েছে।
এমারেল্ড অয়েলের বর্তমান উৎপাদনের পরিমাণ কেমন? এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, কোম্পানি কি পরিমাণ উৎপাদন করে এই মূহুর্তে আমি বলতে পারবো না। বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির এমডির সাথে যোগাযোগের পারমর্শ দেন তিনি।
কোম্পানিটি জাপানে কি পরিমাণ তেল রপ্তানি করবে সে বিষয়েও সাদিয়া আফরিন কিছু বলতে পারেননি। অথচ কোম্পানিটির সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
তবে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে বাজারে কারসাজির আওয়াজ রয়েছে। তবে কী সেই স্বার্থ হাসিলের পথ হিসেবেই একের পর এক প্রাইস সেনসিটিভ তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত করছে কোম্পানিটি। এমনই প্রশ্ন বিনিয়োগকারীদের।
এর আগে ২০২১ সালের ৩ মার্চ কোম্পানিটিতে পাঁচ জন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োগ দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। তখন থেকেই মূলত অভিহিত মূল্যের নিচে থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দামে উত্থান শুরু হয়।
এরপর বিএসইসির নানান উদ্যোগে চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারি কোম্পানিটি আংশিক উৎপাদনে ফিরে। যেদিন কোম্পানিটি উৎপাদনে ফিরেছে, সেই দিনই কোম্পানিটি উৎপাদনে ফেরার খবর ডিএসইকে জানায়। এর আগে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকায়। উৎপাদনে ফেরার খবর চাপিয়ে রেখে শেয়ারদর বৃদ্ধি করে তারপর ডিএসইকে জানিয়েছে কোম্পানিটি। এরফলে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৩৩ টাকা বা ৩৬৬ শতাংশ। যা বিনিয়োগকালীদের সাথে প্রতারণা বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
উৎপাদনে ফেরার পর থেকে কোম্পানিটির নতুন বোর্ডের সময় পার হয়েছে ১০ মাস। এই ১০ মাসেও কোম্পানিটি কোনো বোর্ড সভার তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি। জানাতে পারেনি কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের অবস্থা। এরই মধ্যে আবারও জাপানে রপ্তানির খবর দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটিকে আকর্ষনীয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু কোম্পানিটির উৎপাদনের ফেরার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে ছিলো বিএসইসির কমিশনারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফিরিয়েছে ঠিকই। কিন্তু কোম্পানিটির বোর্ড মিটিংয়ের বিষয়ে এখনও কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ বৈঠকে বসে জাপানে অফিস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও বিনিয়োগকারীদের আর্থিক তথ্য জানাতে পারেনা।
অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিটির নতুন বোর্ড এমন নতুন নতুন তথ্য দিয়ে বাজারের একটি চক্রকে লাভবান করাচ্ছে। এদিকে, বিএসইসি কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফেরাতে পারলেও, আর্থিক প্রতিবেদনের বিষয়ে একেবারেই চুপচাপ। তবে কি জাপানে রপ্তানির খবরের পর নতুন নতুন খবর দিয়ে ফের দফায় দফায় কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির পথ সুগম করে দেবে পরিচালনা পর্ষদ?
এদিকে, এমারেন্ড ওয়েলের শেয়ারের কারসাজির পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার যোগসাজস রয়েছে বলে বাজারে গুঞ্জন রয়েছে। তারা বলছেন, এমারেন্ড ওয়েল নিয়ে বিএসইসির পদস্থ কর্মকর্তারা যতো বাহবা দিয়েছেন, যতো ইতিবাচক কথা বলেছেন; অন্য কোনো কোম্পানি সম্পর্কে এতোটা বলেননি। এমনকি কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে দফা দফায় কারসাজির বিষয়েও কোন উচ্চবাচ্য করেননি। তাহলে কি বিএসইসির যোগ সাজসেই এই কারসাজি হচ্ছে? এমন প্রশ্নই বিনিয়োগকারীদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধির তথ্য:
২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারটির দাম অভিহিত মূল্যের নিচে ৯ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এর পরের মাসে ৩ মার্চ কোম্পানিটিতে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বিএসইসি। তখন থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারটির দৌঁড় শুরু হয়। এরপর তিন মাসের মধ্যে শেয়ারটির দাম আড়াই গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২২ টাকায়। যা এক মাস পর ১০ জুনে সাড়ে ১৮ টাকায় নেমে আসে।
এরপর ২০২১ সালের ১২ জুলাই কোম্পানিটি জানায়, ০১ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। একই তারিখে জানানো হয়, আফজাল হোসেনকে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। এরপর তর তর করে আবার বেড়ে যায় শেয়ারটির দাম। এক মাসের মাথায় ৫ আগস্ট শেয়ারের দাম ৩৭ টাকা ৫০ পয়সায় উঠে যায়।
কিন্তু ২৬ আগস্ট কোম্পানিটি ডিএসইর মাধ্যমে জানায়, ০১ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদন পূর্ণ মাত্রায় শুরু করা সম্ভব নয়। কোম্পানির পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ পরবর্তীতে জানানো হবে কোম্পানি ডিএসইকে জানায়। এই ঘোষণার পর শেয়ারটির দাম পড়ে যায়। যা মাত্র তিনদিনের মাথায় ৩১ টাকায় নেমে আসে।
গত দুই বছরে শেয়ার দামের গ্রাফ
তারপর কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের খবর বাজারে ফের চাউর হতে থাকে। তখন শেয়ারটির দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। শেয়ারটির দাম যখন ৪২ টাকা উঠে যায়, সে সময় অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের সিদ্ধান্ত ডিএসইর মাধ্যমে জানানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্যিক উৎপাদনের খবরটি কোম্পানি গোপন রেখে ধীরে ধীরে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। তারপর উৎপাদনের সিদ্ধান্ত প্রচার করে শেয়ারটি আকাশচুম্বী দামে বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দেওয়া যায়। যার কারণে বাণিজ্যিক উৎপাদনের খবর আসার পরও শেয়ারটির দামে পতন শুরু হয়ে।
এরপর ধারাবাহিক পতনে এপ্রিল মাসে শেয়ারটির দাম ৩১ টাকার নিচে নেমে যায়। এই সময়ে কারসাজিকারীরা শেয়ারটি আবারও ঘুচাতে থাকে। গত কয়েক মাস যাবত শেয়ারটির দাম ৩১ টাকা থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে ঘুরাফিরা করেছে। বর্তমানে ৩৬ টাকা ৮০ পয়সায় ফ্লোর প্রাইসের কাছাকাছি লেনদেন হচ্ছে। শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে ৩৬ টাকা ৪০ পয়সায়। এবার জাপানে নতুন অফিস উদ্বোধনের খবর প্রকাশ করলো কোম্পানিটি। জাপানের টোকিওতে স্থাপিত নতুন অফিসের ঠিকানাও জানিয়েছে কোম্পানিটি। অথচ কোম্পানিটির সচিব বলছেন, জাপানে কোম্পানি নতুন অফিস খোলার পরিকল্পনা করছে কোম্পানিটি।
আর এমন ধোয়াসা তথ্য দিয়েই একের পর এক কোম্পানি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে। আর সেই ধোয়াসার তথ্যকে যাচাই করা যাদের দায়িত্ব তারা কোম্পানিকে উৎপাদনে ফেরাতে পেরেই মহাখুশি। অন্যদিকে, কোম্পানিটি ফন্দি-ফিকিরে পথের ফকির হচ্ছে লাখো সাধারণ বিনিয়োগকারী। এভাবেই বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
শেরপুর জেলার সদরে শেরীপাড়ায় অবস্থিত কারখানাটি ২০১৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্তির দুই বছর পরই কোম্পানিটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি জড়িয়ে জেলে যান। পরে জামিন নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলে কোম্পানির কার্যক্রম ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কোম্পানিটিকে চালু করতে ২০২১ সালের প্রথম দিকে এমারেল্ড অয়েলের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
সর্বশেষ এমারেন্ড ওয়েল ২০১৬ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যংশ দিয়েছে। ওই বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৩ টাকা ৩০ পয়সা। এরপর আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি।
ডিএসইর হিসাব অনুযায়ি, কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৫ কোটি ৯৭ লাখ১৩ হাজার ৫০০টি। এরমধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৩৮ দশমিক ২৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৭ দশমিক শুন্য ৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ।