নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। বিশাল এ অর্থায়নের জন্য দেশের বন্ড মার্কেটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের নির্ধারিত সীমার কারণে বন্ড বাজার শক্তিশালী হচ্ছে না বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তাই সুদহার বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এমন পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
জানা গেছে, দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক। এর অংশ হিসেবে গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। সেই সফরের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী- আগামীতে বেসরকারি খাত থেকে বিনিয়োগের জন্য শুধু ব্যাংক খাত থেকে অর্থায়ন সম্ভব হবে না। তাই বন্ড বাজার থেকে অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বন্ড মার্কেট এখনও সেভাবে শক্তিশালী হয়নি। ২০২০ সালে সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া এর অন্যতম কারণ। ইতোমধ্যে সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রে নির্ধারিত বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে নানা সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সঞ্চয়পত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এভাবে বাড়তে থাকলে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী হবে না।
সংশ্নিষ্টরা সূত্র থেকে জানা যায়, উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি রয়েছে বন্ড মার্কেটের শক্ত অবস্থান। বড় প্রকল্পে অর্থায়নে অনেক দেশের সরকারও বন্ড ছাড়ে। তবে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট খুবই ছোট। বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। নির্ধারিত সুদহার এ বাজার সম্প্রসারণে অন্যতম বাধা হলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাও বন্ড মার্কেট সম্প্রসারণের বড় বাধা।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ম্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ, সেখানে ব্যাংক ঋণে সুদহারও ৯ শতাংশ। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছে। কারণ বন্ড বাজার থেকে ৯ শতাংশে ঋণ পাওয়া কঠিন। বর্তমানের মূল্যস্ম্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদহার বাজারভিত্তিক করার কথা বলেছে বিশ্বব্যাংক, যা যৌক্তিক।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশনার আরিফ খান সমকালকে বলেন, নির্ধারিত সুদহার বন্ড মার্কেট শক্তিশালী না হওয়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া দেশের ব্যাংকিং পদ্ধতির কারণেও বন্ড মার্কেট আজ পর্যন্ত দুর্বলই রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংক খাত স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয়, কিন্তু বাংলাদেশে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নের বেশিরভাগই ব্যাংক করে। তাই উদ্যোক্তারা বন্ড মার্কেটে আসে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখনও বেশ জটিল প্রক্রিয়ায় বন্ড ক্রয়-বিক্রয় হয়। তাই বন্ড মার্কেট শক্তিশালী হতে পারছে না।
ঋণের সুদহার বেঁধে দেওয়ায় বড়রা উপকৃত হলেও ছোটরা বঞ্চিত হয়েছে- এমন তথ্য পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের তৈরি করা 'ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অব ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপস অ্যান্ড পোটেনশিয়াল পলিসি অপশন্স: বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ' শীর্ষক প্রতিবেদনে। সুদহার বেঁধে দেওয়া বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে।
এতে দেখা গেছে, ঋণের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের সুদ বাস্তবায়ন হওয়ার পর দেশের ধনিক শ্রেণি বা বড় উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। আর ঋণবঞ্চিত হয়েছেন কৃষি ও সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। ব্যাংকগুলোর কনজিউমার, রিটেইল বা খুচরা ঋণের পোর্টফোলিও ছোট হয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারের বাঁধ তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ।