নিজস্ব প্রতিবেদক: এগারো ব্যাংকের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ঋণের অভিযোগ ওঠেছে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে আগ্রাসীভাবে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ৬টি শরিয়াহভিত্তিক এবং ৫টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক।
জানা গেছে, শরিয়াহ ব্যাংকের অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাতসীমা ৯২ শতাংশ। তবে এই ধারার ব্যাংক হিসাবে ১০৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে রেকর্ড গড়েছে একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ব্যাংকটি সীমার চেয়ে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি ঋণ দিয়েছে, যা আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তবে প্রচলতি ধারার ব্যাংকের এডিআর সীমা ৮৭ শতাংশের স্থলে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) ঋণ বিতরণ করেছে ৯৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসলামি শরিয়াহ পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের ডিসেম্বরে এডিআর ৯৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। একই মাসে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এডিআর ৯৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ সময় একই ধারার আরও তিনটি ব্যাংকের এডিআর যথাক্রমে ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও ৯৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আগ্রাসী ঋণের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে সীমার বাইরে ঋণ দিলে ঋণ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। এছাড়া ব্যাংকের ঋণ আদায়ের চিত্রও এখন খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এমন অবস্থায় অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে যদি খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ব্যাংকের পাশাপাশি আমানতকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ হস্তক্ষেপ দরকার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত ৮৭ শতাংশ নির্ধারিত থাকলেও গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) ঋণ বিতরণ করেছে ৯৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এটি এডিআর সীমার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা প্রচলিত সব ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর পরই রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির এডিআর ৮৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। একইভাবে
আইএফআইসি ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৮৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে। তবে প্রচলিত ধারার বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এডিআর রেশিও ঠিক রাখতে পারলেও ইসলামি উইন্ডোতে নিয়ম ভঙ্গ করে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ৯৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এছাড়া আরও একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রচলিত এবং ইসলামি উইন্ডো-উভয় ক্ষেত্রে এডিআরসীমা অতিক্রম করেছে, যা যথাক্রমে ৯২ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ৯৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত সীমায় ঋণ বা বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতি এবং তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও সীমা লঙ্ঘন করেছে এসব ব্যাংক।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিআরসীমা নিঃসন্দেহে অনেক হিসাবনিকাশ করে দিয়েছে এবং তা যথেষ্ট বৈশ্বিক মানের। সেই সীমা অতিক্রম করা ঠিক নয়। এতে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশেষ করে আমানতকারীরা বেশি ঝুঁকিতে পড়বেন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে, এর একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। তবে ব্যাংকগুলোর এ অনুপাত বিভিন্ন সময় ওঠানামা করে। কারণ, কোনো ব্যাংকের যদি বড় একটি আমানত আসে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে।
যদি গ্রাহক আমানত তুলে নেয় তখন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে। তখন ব্যাংক তার এডিআরসীমার বাইরে চলে যায়। এটা সাময়িকও হতে পারে। তবে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ব্যাংক এডিআরসীমার বাইরে থাকলে সেই ব্যাংককে অবশ্যই চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হবে। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’