নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। এ ছাড়া বর্তমানে অন্যতম বাধা হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থ পাওয়ার সীমাবদ্ধতা, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও মূল্যস্ফীতি। এসব বাধার পাশাপাশি আগামীর অর্থনীতিতে বেশকিছু ঝুঁকিও রয়েছে। দ্রুত বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট ও নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতা এর মধ্যে অন্যতম। এতে জীবনযাপন ব্যয় দিনদিন বেড়ে চলেছে। ঝুঁকি সৃষ্টি করছে কর্মসংস্থান ও জীবিকায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২২ : উদ্যোক্তা জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ এর তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসার পরিবেশের অধপতন হয়েছে। সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল রোববার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জরিপের তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
এ জরিপে অংশগ্রহণ করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনের ফল তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই সময়ে এ জরিপ করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণ করা দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মকর্তা দুর্নীতিকে ব্যবসার বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। কোন কোন জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও জরিপে উঠে এসেছে। কর দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় এমনটি জানিয়েছেন ৬৪ শতাংশ কর্মকর্তা। এর পরেই ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা আমদানি-রপ্তানিতে দুর্নীতির কথা বলেছেন।
এ ছাড়া ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যবসার জন্য দুর্বল অবকাঠামো, ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংকঋণের অপর্যাপ্ততা ও অনভিজ্ঞ প্রশাসন, ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ জটিল করব্যবস্থা ও উচ্চ করহার, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ দুর্বল নীতি-নৈতিকতা ও সরকারে স্থিতিশীলতার অভাব, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ অপরাধ ও উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তা শ্রম-সংক্রান্ত নিয়মনীতির সীমাবদ্ধতাকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।
জরিপে অংশগহণ করা ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ বলছেন, এ সময় বিভিন্ন মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঘটনা বেড়েছে। অনেক টাকা পাচারের ফলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলেও জানান তারা। জরিপে বলা হয়, ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। দেশে সংগঠিত অপরাধ বাড়ছে। এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র দেশ গড়ে উঠেছে। এটিকে এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নির্বাচনী বছরে অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন তার বক্তব্যে বলেন, দুর্নীতির ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সেবার মূল্যও বাড়ছে। এই বাড়তি মূল্যের ঘানি সাধারণ মানুষকেই টানতে হয়। নানা স্তরের দুর্নীতি ব্যবসার পরিবেশ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শর্ত সাপেক্ষে আইএমএফের ঋণ বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের প্রয়োজন বিসর্জন দিয়ে চাপ নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আর এত বেশি ঋণ নিয়ে ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে।
দুর্নীতির পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ব্যবসাকে আরও সমস্যায় ফেলছে মন্তব্য করে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে বৈদেশিক মুদ্রার উত্থান-পতন, আমলাতন্ত্র ও মূল্যস্ফীতি। আর বড় ব্যবসায়ীদের জন্য এসবের পাশাপাশি অবকাঠামোর অপ্রতুলতা সমস্যার সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার আচরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তিনি জানান, নির্বাচনের বছর সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তি আরও বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি জানান, বড় কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে এসএমইরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদন, খুচরা বিক্রিতেও বড় কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সবার জন্য একই রকম নীতি কাঠামো কার্যকর হয় না। বড়, মধ্যম ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা নীতি কাঠামো প্রয়োজন। তা নাহলে এসএমইরা টিকে থাকতে পারবে না। শেয়ারবাজার সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের দুর্বলতা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। আর্থিক খাতের ৪ টি অঙ্গই বিপর্যয়ের মুখে। সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজার এখন ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ নিয়েছে।
সিপিডি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের অগ্রগতি দেখা যায়নি। হয় এটি স্থবির ছিল, নতুবা আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত কারণ হিসেবে ‘দুর্নীতি’ এখনো রয়ে গেছে। তবে অন্যান্য কাঠামোগত এবং নতুন নতুন সমস্যার কারণে দুর্নীতির তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এই জরিপে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা নেওয়া। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একটি বড় সংস্কার নিশ্চিত করা। আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। নাগরিক এবং ব্যবসায়িক সেবা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে সংস্কার, নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ করার অঙ্গীকার করা।