নিজস্ব প্রতিবেদক: দুদিন বাদেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও গরমকালে রমজান হচ্ছে। একই সময় শুরু হয়েছে সেচনির্ভর বোরো-ইরি ধান লাগানোর সময়। ফলে এই সময়টাতে বিদ্যুতের চাহিদা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। এজন্য গ্রীষ্মের এই সময়ে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ঠিক রাখতে প্রতিবছরের মতো এবারও নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
তারপরও আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে লোডশেডিং হবে না এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সরকার। নানা উদ্যোগেও থামবে না লোডশেডিং। বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে গ্রীষ্মকাল ধরা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মার্চ থেকেই গরম পড়তে শুরু করে। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বাড়ে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছরই বিদ্যুতের চাহিদা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে বাড়ে। দেশে এখন গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আসন্ন রমজানে এবং সেচ মৌসুমে এই চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে।
বিদ্যুতের এই চাহিদার বিপরীতে জ্বালানি সংকটের কারণে সর্বোচ্চ ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ফলে সর্বোচ্চ চাহিদার বিপরীতে ২ থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত ঘাটতি থাকবে।
খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ রমজান ও গ্রীষ্মে লোডশেডিং হতে পারে বলে জানিয়েছেন। গত ১৪ মার্চ রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য ব্যবহৃত জমির বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে আয়োজিত ওয়ার্কশপ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। আমরা বিদ্যুতের এই সমস্যা নিরসনে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, রমজান ও সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। গত বছরের তুলনায় এবার বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট হবে।
তিনি জানান, গ্যাস থেকে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়; কিন্তু সেটি এখন কমে গেছে। অন্যদিকে শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিছু কারখানায় গ্যাস ছাড়া বিকল্প জ্বালানি নেই। ফলে শিল্প খাতে দেওয়ার পর যে পরিমাণ গ্যাস থাকবে তা দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এজন্য পেট্রোবাংলার কাছে ১ হাজার ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া খরচ বেশি হওয়ায় আপাতত তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ডিজেলের ব্যবহার করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এখন সম্ভাব্য ঘাটতি থাকছে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এই ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিংয়ের দিকে গেলেও গ্রাহকের জন্য তা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
বর্তমানে দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৪টি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। গত বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৬৫টি। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২২৮ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ৪৯ শতাংশ।
অন্যদিকে, ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৪টি। উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৬ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক ৫ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৬১২ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য খাত থেকে উৎপাদিত হয় ৪৮৯ মেগাওয়াট। আমদানি করে আনা হচ্ছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।
তবে ডলার ও জ্বালানি সংকটের ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে। গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের পরিমাণও অর্ধেকে নেমেছে। অন্যদিকে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়লা, ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লা থেকে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট আর ফার্নেস অয়েল থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। রামপাল, পায়রা ও বরিশালের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়াসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পাওয়া যাবে।
এছাড়া, নবায়নযোগ্য খাত থেকে পাওয়া যাবে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানো হবে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এখন সম্ভাব্য ঘাটতি থাকছে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানির সংস্থান করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরের শুরু থেকেই ডলার সংকটে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি না করতে পারায় এক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ফলে শীত মৌসুমেও লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়েছিল গ্রাহকদের। নিয়মিত ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
এ ছাড়া গ্যাসের বাইরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখছে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো। এর বড় অংশই বেসরকারি খাতের। এপ্রিল-মে মাসে পিডিবি ফার্নেস অয়েল থেকে ৩ হাজার ৮৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। এ জন্য মাসে ৫ লাখ ৪ হাজার ৮৫২ টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে হবে।
এই ফার্নেস অয়েল আমদানিতে মাসে লাগবে প্রায় ২৩ কোটি ডলার। ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে সহযোগিতা চায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এই বিষয়ে বলেন, সরকার মূলত সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার আশায় ছিল। মার্চের মধ্যে এ বিদ্যুৎ আসবে বলা হলেও বাস্তবে তা আসেনি। জ্বালানি কেনার বিষয়টিও এখনো পরিষ্কার হয়নি। এই ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ফুয়েল আমদানি করতে পারছে না। ফলে রমজান ও গ্রীষ্মে প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে।
তবে সাশ্রয় নীতির মাধ্যমে এক হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এর পরও চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থেকে যাবে। ফলে লোডশেডিং করতে হবে বলে তিনি জানান।