নিজস্ব প্রতিবেদক: তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পদ গড়েছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। কাগজে-কলমে সেই সম্পদের মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু কারা সেই ৪৫৯ বাংলাদেশি? কারা দেশ থেকে সম্পদ নিয়ে দুবাইয়ে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তা জানা গেল না এক বছরেও।
এর আগে ২০২২ সালে ২ মে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএডিএস) এক প্রতিবেদনে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার এমন সম্পদের তথ্য ওঠার একপর্যায়ে নজরে আসে দেশের উচ্চ আদালতেরও।
আদালত তদন্ত করে তাদের নাম, পরিচয় ও অর্থ পাঠানো মাধ্যমগুলো জানতে আদেশ দেন চারটি তদন্তকারী সংস্থাকে। তারাও হাইকোর্টের সেই আদেশ তিন মাস পার করিয়ে দিল; কিন্তু তদন্তের পালে হাওয়া বইল না।
অজুহাত হিসেবে তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, (দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)) বিষয়টি গণমাধ্যম থেকে জেনেছেন।
কিন্তু আদালতের আদেশের লিখিত কোনো কপি হাতে পায়নি। তাই তদন্ত শুরুও করতে পারেনি তারা। যদিও এর আগে গণমাধ্যম থেকে পাওয়া এমন অনেক তথ্যেরই তদন্ত করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো।
তদন্তকারী সংস্থাগুলোর এমন বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেছেন, আদালতের লিখিত আদেশ না পাওয়ায় তদন্ত শুরু করা যায়নি, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। যেহেতু ওই সংস্থাগুলো এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে, তাই তাদের নিজেদের উদ্যোগেই এটি করা উচিত ছিল।
সম্প্রতি পুলিশ খুনের মামলার পলাতক আসামি আরাভ খানের দুবাইয়ে বিলাসবহুল জীবন ও স্বর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র করে দেশজুড়ে হৈচৈ পড়েছে।
সবাই প্রশ্ন তুলছেন, আরাভের হাতের এত টাকার ব্যবসা আসলে কাদের? কারাই বা দেশ থেকে গোপনে টাকা পাচার করে আরাভদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করছেন।
সঙ্গেই আলোচনা করছেন, গত ১৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশে দুবাইয়ে সম্পদ গড়া ৪৫৯ জনের বিষয়ে তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বললেও তিন মাসেও কেন তাদের নাম সামনে এলো না!
এই বিষয়ে একটি সংস্থার দাবি, তদন্ত শুরু না করলেও প্রাথমিকভাবে ওই ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা জানার চেষ্টা চলছে। সংখ্যাটি এখনো বলার মতো হয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, দুবাইয়ে অর্থ পাচার করা ওই ব্যক্তিরা শুধু বিপুল সম্পদের মালিকই নন। তাদের রয়েছে রাজনীতিক ও সামাজিক পরিচয়।
গত বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সি৪এডিএস) এক প্রতিবেদনে বলছে, তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পদ কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি।
ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি সূত্র ধরে তারা বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশিদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।
তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য এখন পর্যন্ত কাউকে আরব আমিরাতে বৈধ পথে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি।
এসব সম্পদের মধ্যে ৬৪টি দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা দুবাই মেরিনা ও ১৯টি পাম জুমেইরাতে অবস্থিত। যেখানে অন্তত ১০০টি ভিলা ও কমপক্ষে ৫টি ভবনের মালিক বাংলাদেশি বলে জানা গেছে।
চার থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। যদিও প্রতিবেদনে কারও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থিক খাত এবং রিয়েল এস্টেট পাচারকৃত অর্থের প্রধান খাত। দুবাইয়ে যেসব বাংলাদেশি সম্পত্তির মালিক, তাদের মধ্যে ৩৩২ জন পুরুষ।
দুবাইয়ের বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট মালিকদের মধ্যে ৩১৮ জনের বয়স ৩৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, ৪২ জনের বয়স ৩৪ বছরের কম এবং ৯৭ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম নিয়ে কাজ করা একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ গোল্ডেন ভিসা সুবিধা চালু করার পর বাংলাদেশিদের দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়ের মাত্রা হু হু করে বাড়ছে।
বিত্তবান বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে এই ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থসম্পত্তির মালিকানা থাকলেই এ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। শর্ত সহজীকরণের পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতাগুলোও দূর করা হয়েছে।
দেশের ধনীদের অনেকেই ইউএইর দেওয়া এই সুযোগ লুফে নিয়েছেন। দেশের ব্যাংক পরিচালক, রাজনীতিবিদ, পোশাক ব্যবসায়ী, সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। তাদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ সিআইডি বলছে, দেশটিতে অবৈধভাবে টাকা পাঠানো সহজ হওয়ায় বাংলাদেশিরা সেদেশে বিনিয়োগ করেছেন।
সিআইডির মতে, তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশি নাগরিকত্বের পরিচয় গোপন করে অন্য দেশের পরিচয় ব্যবহার করেছেন। কারণ, এখন টাকা দিলেই মেলে অনেক দেশেরই পাসপোর্ট।
দুবাইয়ে বসবাস করা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুবাইয়ে তিন-চার কক্ষের ফ্ল্যাট কিনতে মোটামুটি খরচ হয় তিন থেকে চার লাখ দিরহাম, যা বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার সমান।
অর্থাৎ রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর চেয়ে দুবাইয়ে ফ্ল্যাটের মূল্য কম। ফ্ল্যাটের মালিক বাংলাদেশিরা কেউ কেউ এখানে অবস্থান করলেও বেশির ভাগ দেশেই থাকছেন। কেউ কেউ বাড়ি দেখাশোনার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের রেখেছেন।