নিজস্ব প্রতিবেদক: পবিত্র রমজান মাসে পাবনা-সিরাজগঞ্জে তরল দুধের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু দুধের উৎপাদন বাড়েনি। বরং কমেছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার তরল দুধের ঘাটতি রয়েছে।
দুধের এই ঘাটতি মেটাতে তৈরি হচ্ছে নকল দুধ। ছোলার টক পানি, দুধের গুঁড়া, সয়াবিন তেল, হাইড্রোজেন, লবণসহ বিভিন্ন উপকরণ ও রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নকল দুধ। পবিত্র রমজান মাসে এই অঞ্চলে এভাবেই চলছে সাদা দুধের কালো ব্যবসা।
স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়িতে বড়াল নদীর তীরে বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা নামে একটি দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। দুগ্ধ শিল্পকে ঘিরে ৪২ হাজারটিরও বেশি গবাদি পশুর খামার তৈরি করা হয়েছে। এসব গাভী থেকে প্রতিদিন গড়ে চার লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়।
এছাড়া পাবনা-সিরাজগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু পালন করা হয়। এসব গরু থেকে এক লাখ থেকে এক লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। এই দুধ মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশকরা ক্রয় করে থাকে।
প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্র্যাক ফুড (আড়ং), ফ্রেশ মিল্ক, নাভানা মিল্ক, আমোফ্রেশ মিল্ক, কোয়ালিটি, বিক্রমপুর সহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহের জন্য এই অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা ডেইরি স্থাপন করেছে। ফলে দিন দিন তরল দুধের চাহিদা বাড়লেও দুধের উৎপাদন বাড়েনি।
দুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করে বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে। তাদের দেখে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন নকল দুধ তৈরিতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রমজান মাসে এই অঞ্চলে দুধের দৈনিক চাহিদা এক লাখ লিটার থেকে বেড়ে সাড়ে সাত লাখ লিটারে উন্নীত হয়েছে। অথচ দৈনিক দুধ উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ লিটার।
এই ঘাটতি পূরণে অসাধু ব্যবসায়ীরা টক পানি, ক্ষতিকর দুধের গুঁড়া, ফরমালিন, সোডা, সয়াবিনসহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাবনার বড়, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘরিয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজিপুর উপজেলার ঘোষ ব্যবসায়ীরা তাদের কারখানায় প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লিটার দুধ উৎপাদন করেন।
প্রথমত, দুধ থেকে ১০০% ননি (চর্বি) সরানো হয়। পরে অনানী দুধ জ্বালিয়ে নিম্নমানের ছানা উৎপাদন করে। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছোলার টক পানি ফেলে না দিয়ে বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করেন। পরে ছানার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করা হয়।
রমজানে দুধের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়; কিন্তু উৎপাদন বাড়ে না। সেই সুযোগে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘোষ নকল দুধ তৈরি করে বিক্রি করছে। প্রতিটি ছানার পানিতে আধা কেজি ননি, আধা কেজি স্কিম মিল্ক পাউডার, অল্প পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, এক কেজি চিনি এবং দুধের কৃত্রিম স্বাদ মিশিয়ে নিখুঁতভাবে দুধ তৈরি করছেন তারা। রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া এটি আসল না নকল তা জানার কোনো উপায় নেই। তারা দুধ তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ঘোষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই নকল দুধ সংগ্রহ করে দুধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে পাঠায়। পরবর্তীতে প্রক্রিয়াকরণের সময়, আসল দুধের সাথে নকল দুধ মেশানো হয় এবং সমস্ত দুধ ভেজাল হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তারা আধা কেজি দুধ ননি, আধা কেজি স্কিম মিল্ক পাউডার, কয়েক ফোঁটা কাটিং অয়েল, ২৫০ গ্রাম হাইড্রোজেন সমপরিমাণ লবণ, ৫০০ গ্রাম সয়াবিন তেল ও এক ফোঁটা মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করে। এক কাপ ফুটন্ত পানিতে ফরমালিন। ভারত থেকে সীমান্ত পথ দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে ক্ষতিকর স্কিম মিল্ক পাউডার।
সূত্র জানায়, নকল দুধে চিনি, লবণ, হাইড্রোজেন ও সয়াবিন তেল ব্যবহার করা হয় বলে ল্যাকটোজ ও দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ের জন্য ল্যাকটোমিটারের সাহায্যে ভেজাল শনাক্ত করা যায়। এটি দুধের ঘনত্ব এবং ল্যাকটোজ বাড়ায়। দুধ তাজা রাখতে ফরমালিন দেওয়া হয়। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযানে ল্যাকটোমিটার দিয়ে ভেজাল দুধ শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
নাভানা মিল্ক ম্যানেজার জগলুল হায়দার বলেন, আমাদের দুধ সংগ্রহ ব্যবস্থা শতভাগ ভেজাল। ভেজালমুক্ত তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে কোম্পানির নিজস্ব কর্মচারীদের দ্বারা সরাসরি গরুর খামারি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডাঃ জামাল হায়দার চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন রাসায়নিক মিশ্রিত দুধ পান করলে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ফরমালিন গ্রহণের ফলে হেপাটো-টক্সিসিটি বা লিভার রোগ, কিডনি রোগ হতে পারে। ক্ষতিকর দুধের গুঁড়া মানবদেহে হাড়ের ক্ষয় ঘটাতে পারে। ফলে শরীরের পিঠে ব্যথা, চর্মরোগ, হজমের সমস্যা, পেটে ব্যথাসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে।