নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত বলেছেন, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে কালো টাকা ও অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ১৩৫ লাখ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মাত্র ৭ শতাংশও যদি উদ্ধার করা যায়, তাহলে অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবিত ২১ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট বাস্তবায়নের যে ঘাটতি, তা অনেকখানি পূরণ হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকার বিকল্প বাজেটের প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন তার তুলনায় ২.৭ গুণ বেশি তাদের এই বাজেটের পরিমাণ। আগামী ১ জুন অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কার্যালয়ে এই বিকল্প প্রস্তাব দেন সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৩-২৪: বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট শীর্ষক অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম।
আগামী ১০ বছরে ছয়টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত বলেন, সেগুলো হচ্ছে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত করা, বৈষম্য সর্বনিম্ন শ্রেণিতে নামিয়ে আনা, ধনিক শ্রেণির সম্পদ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বণ্টন, উন্নয়নে দেশজ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক ও আলোকিত করার সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন কর্মবাজার সংকোচন, মহামারি ও ইউরোপ যুদ্ধের অভিঘাত—এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিকল্প বাজেটে কালো টাকাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি মন্তব্য করে অধ্যাপক বারকাত বলেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে কালো টাকার পরিমাণ মোট ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মাত্র ২ শতাংশ সরকারকে উদ্ধারের প্রস্তাব করেছি। এটা যদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে সরকার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা পাবে।
এ সময় অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মোট পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে বলা হয়েছে, ওই অর্থের মাত্র ৫ শতাংশ যদি উদ্ধার করা যায় তাহলে সরকার ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা পাবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের ওই খাত।
তিনি আরও বলেন, বিকল্প বাজেটের হিসাবে রাজস্ব আয় থেকে আসবে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা চলমান অর্থবছরের (২০২৩-২৪) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪.৪২ গুণ বেশি। অর্থাৎ মোট বাজেটের ৯৩.২ শতাংশের জোগান দেয় রাজস্ব। বাকি ৭.৮ শতাংশ তথা ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি হবে ঘাটতি বাজেট।
এ বিষয়ে অধ্যাপক বারকাত বলেন, এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর অর্থাৎ আয়কর প্রস্তাব ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশে কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন ১০০ জনের মতো। আমাদের গবেষণা বলছে, এই সংখ্যা ৪ লাখ ১৮ হাজার মানুষ কোটি টাকার ওপরে কর দেওয়ার কথা। আর সম্পদ কর নেওয়া হয় না। এই খাতে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আসা সম্ভব। ভ্যাট খাতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান সরকারের বাজেটের মতোই। এই খাতে হাত দেয়নি, কারণ ভ্যাট বৈষম্য হ্রাসে কোনো সহায়তা করে।
অন্যদিকে এনবিআরবহির্ভূত কর—যেমন মাদক শুল্ক ১৫২ কোটি টাকা। যেখানে ৩০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে এবং ভূমি রাজস্ব থেকে আসবে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
বিকল্প বাজেটে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হবে। আর বাজেট ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও আমরা বিদেশি অর্থায়ন ও ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষে নেই। বরং ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র, বন্ড, বিদেশে বসবাসরত নাগরিক ও কোম্পানি থেকে নেওয়ার কথা বলেছি।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন কর্মবাজার সংকোচন, মহামারি ও ইউরোপ যুদ্ধের অভিঘাত এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। ধনী ও অতি ধনীর সংখ্যা ১ শতাংশ। বহুমাত্রিক দরিদ্রের সংখ্যা কভিডকালীনের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে প্রকৃত মজুরি না বাড়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। সঞ্চয় ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে।
অনেকেই ধার-দেনা করে জীবন চালাচ্ছে, আমিষ জাতীয় খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। পূর্ণ কর্মসংস্থান, শিশুর জন্য সুস্থ জীবন, সবার জন্য আবাসন ও মূল্যস্ফীতি রোধ এই বিষয় মাথায় রেখে অর্থনীতি সমিতি বাজেট প্রণয়ন করেছে।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আরও বলেন, সম্পদ কর থেকে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব। বৈষম্য কমাতে হলে সম্পদ করে হাত দিতে হবে। সম্পদশালীদের ওপর কর কমানো হলে বৈষম্য কমে না। এ ছাড়া সমাজের ৯০ শতাংশ কম আয়ের মানুষের ওপর কর কামালে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে।
বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা এবং ৪৫টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।