ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪
Sharenews24

সালমানের পকেটে ইনডেক্সের ৪ হাজার কোটি টাকা

২০২৪ সেপ্টেম্বর ০৭ ১৭:৫৩:১৯
সালমানের পকেটে ইনডেক্সের ৪ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংবাদ উপাস্থাপিকা জাকিয়া তাজিন। তার স্বামী ছিলেন ইনডেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিউল্লাহ আল মুনির। গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে তার জাকিয়ার সাথে পরিচয় হয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। সালমানের সাথে তাজিনের তৈরি হয় অবৈধ সম্পর্ক। এরপর জাকিয়া আর সালমান মিলে ইনডেক্স গ্রুপের নামে ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন সালমান এফ রহমান।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৬ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ইনডেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শফিউল্লাহ আল মুনিরকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারীরা। প্রায় এক মাস নিখোঁজ থাকার পর গুলশান জোনের ডিসি (ডিবি) মশিউর রহমান ও তৎকালীন এডিসি (বরখাস্ত) গোলাম সাকলাইনের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাকে আদালতে নেওয়া হয়। গুম থাকা অবস্থায় মুনিরের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ব্যাংকের চেক ও অফিসিয়াল ডকুমেন্টে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এরপর ই-অরেঞ্জ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত জয়ন্ত কুমার দেবের মাধ্যমে ইনডেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইনডেক্স এলপিজির নাম পরিবর্তন করে বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১ ও ২ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মালিকানা পরিবর্তন করা হয় গ্লোবাল এলপিজি ও এগ্রো ইনডেক্সেরও।

ইনডেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পরিবর্তন ও ইনডেক্স এলপিজির নাম পরিবর্তন করে দুটি প্রতিষ্ঠান গঠনের পুরো কাজই করেছেন জয়ন্ত কুমার দেব, যার বিরুদ্ধে ই-অরেঞ্জ কেলেঙ্কারিসহ বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি মুনিরের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য বাদী জোগাড় করেছেন এই জয়ন্ত। আর মামলা সাজানোসহ সংশ্লিষ্ট বাকি কাজগুলো করেন নৌ পুলিশের এসপি আব্দুল্লাহ আরেফ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ওএসডি হওয়া ওই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসানোর লোভ দেখিয়ে এসব কাজ করিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান।

এ বিষয়ে জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘আমি মুনিরের কাছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পাই। ওই টাকা আদায়ের জন্য তার বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছি। এ ছাড়া অন্য মামলাগুলোর বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আর তার কোম্পানি দখলের ক্ষেত্রে আমার কোনো হাত নেই। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। উল্টো সালমান এফ রহমানের সঙ্গে মিলে সে আমার বাড়িতে কয়েকবার পুলিশ পাঠিয়েছিল। তা ছাড়া ই-অরেঞ্জের প্রতারণার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

তথ্য বলছে, শফিউল্লাহ আল মুনিরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রমনা থানায় নেওয়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে লাল রঙের একটি গাড়িতে করে জয়ন্ত, জাকিয়া তাজিন ও আব্দুল্লাহ আরেফ থানায় উপস্থিত হন। এরপর এই তিনজন থানা হাজতে মুনিরের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান। অথচ আইন অনুযায়ী বাইরের কাউকে হাজতে ঢুকতে দেওয়ারই সুযোগ নেই।

বিভিন্ন মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, সালমান এফ রহমান মুনিরকে একের পর এক মামলায় জড়িয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেন। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল শফিউল্লাহ আল মুনিরের নামে কাফরুল থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলা নং-৬/৯৪। ওই মামলার বাদী নিজেই বলেছেন, তিনি মুনিরকে চেনেন না, তার নামে তিনি মামলাও করেননি। এই মামলার ঠিক এক মাস ৫ দিন পর ১১ মে মিরপুর মডেল থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ২০(৫)২১। ওই মামলায় পুলিশের তদন্তে পাওয়া যায়, বাদী যে ঠিকানা দিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এই নামে কোনো বাদীকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং বাদীর যে নাম ও ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ মামলা থেকেও মুনিরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই মামলায় জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রমনা থানায় আরেকটি মামলা (নং ২৯, তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০২১) করা হয়। এই মামলা থেকেও পুলিশ মুনিরকে অব্যাহতি দেয়।

এ বিষয়ে মুনির বলেন, ‘১৮ ও ১৯ মে রিমান্ডে এনে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে রমনা থানা থেকে চোখ বেঁধে বের করেন তৎকালীন ওসি মনিরুল। এ সময় সালমান এফ রহমানের সহযোগী জয়ন্ত কুমারও সঙ্গে ছিলেন। সাবেক স্ত্রী জাকিয়া তাজিন বিভিন্ন সময়ে দিকনির্দেশনা দিতেন জয়ন্তকে, সেগুলো পুলিশ দিয়ে বাস্তবায়ন করা হতো। পুলিশ তাকে নিয়ে বাসা ও অফিসে নিয়ে পাঁচটি গাড়ির চাবি, সব দলিলপত্র, ব্যাংকের চেক বই নিয়ে যায়।’

২০২১ সালের ২৪ মার্চ শেরেবাংলা নগর থানায় মুনিরের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ৪৩। এই মামলারও বাদী পায়নি পুলিশ। একই বছরের ১৯ মে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ৩৬(৫)২১। এই মামলারও বাদীর নাম-ঠিকানা সঠিক পায়নি পুলিশ। তারপরও সালমান এফ রহমানের চাপে মামলাটি ফের তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। সিআইডি সার্বিক তদন্তের পর ফাইনাল (চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা) রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মুনিরের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।

সালমান এফ রহমানের ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি মামলা (নং- ৪/২৮৯)। এই মামলায় অভিযোগ করা হয়, ২০২০ সালের ৬ জুন বাদীকে পিস্তল ধরে মেরে ফেলার হুমকি দেন। অথচ পিস্তল ধরে হুমকি দেওয়ার দিনক্ষণ যখন দেওয়া হয়, তখন মুনির ছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে বন্দি। ওই মামলায় সালমান এফ রহমানের সরাসরি নির্দেশনায় মুনিরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। একই বছর ৮ আগস্ট মুনিরের নামে গুলশান থানায় আরেকটি মামলা (নং ২৮) দেওয়া হয়। এই মামলার তদন্ত দেওয়া হয় সিআইডিকে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানান, ‘মুনিরের নামে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আসামিরা মুনিরকে চেনে না এবং বাদীও মুনিরকে চেনে না। তাই এই মামলা থেকেও মুনিরকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’

এসব বিষয়ে ইনডেক্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী শফিউল্লাহ আল মুনির বলেন, ‘আমাকে হেনস্তা করে কোম্পানি দখলের জন্য সালমান এফ রহমান ১৪টি বানোয়াট মামলা দিয়েছেন। নিজের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতারক, চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ী আখ্যায়িত করে একের পর এক সংবাদও প্রচার করেন। আমার ব্যবসা, সংসার এমনকি আমার পুরো জীবন সে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিভিন্নভাবে আমার কোম্পানির অন্তত ১২০০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছে। আর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।’

মুনির বলেন, ‘২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আমি জেলে ছিলাম। ওই সময় গুলশান থানায় করা একটি মামলায় আমাকে শ্যোন অ্যারেস্ট করতে আদালতে আবেদন করা হয়। সেটি ছিল পুরোনো (পেন্ডিং) মামলা। পুলিশের এজাহারে আমার নামও ছিল না। এমনকি বাদীও আমাকে চিনতেন না। এই মামলায় পরে ওপরের চাপে আমাকে অ্যারেস্ট দেখানো হয়। এ ছাড়া আমি জেলে থাকা অবস্থায় ঘটেছে, এমন ঘটনার মামলায়ও আমাকে আসামি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমার কর্মীরা আমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাদের নামেও মামলা দেওয়া হয়েছে, যাতে আমি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কেউ আমার পক্ষ অবস্থান নিতে না পারে।’

শফিউল্লাহ আল মুনিরের বিরুদ্ধে শুধু মামলা দিয়েই ক্ষান্ত হননি সালমান এফ রহমান। তার স্ত্রী জাকিয়া তাজিনকে সঙ্গে নিয়ে ইনডেক্স গ্রুপের সবগুলো কোম্পানি দখল করে নেন। এরপর এসব কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জাকিয়া তাজিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। গুলশান ১-এর ১২৩ রোডের ৩৭নং বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়িটিতে ৭ হাজার স্কয়ার ফিটের ট্রিপলেক্স অংশের মালিক ছিলেন শফিউল্লাহ আল মুনির। তাজিন এই বাড়িটির মালিকানাও নিজের নামে নিয়ে গেছেন।

ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, নাম পরিবর্তন করে গড়ে তোলা বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২-এর অনুকূলে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ফান্ডেড ১ হাজার ২৩৪ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৫৯ কোটিসহ মোট ১২০৩ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। এ ছাড়া একই কোম্পানির নামে আরেক বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ১০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক মিলিয়ে সালমান এফ রহমান এ দুই প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেক্সিমকো এলপি ইউনিট-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এখনো শফিউল্লাহ আল মুনিরের নাম রয়েছে। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান। সেক্ষেত্রে তিনি নমিনাল ডিরেক্টর হিসেবে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

শফিউল্লাহ আল মুনিরের কাছ থেকে দখল করা অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্লোবাল এলপিজির নামে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৪৫০ কোটি টাকাসহ মোট ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। আর এগ্রো ইনডেক্সের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় আরও ৫০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার ছেলে সায়ান এফ রহমান ঢাকায় ফিরে এগ্রো ইনডেক্সের ৫০০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন। এ ছাড়া যেসব ঋণে ভবিষ্যতে ঝামেলা তৈরি হতে পারে, সেসব ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করছেন।

এস/

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে