ঢাকা, রবিবার, ৫ মে, ২০২৪
Sharenews24

শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

২০২৩ নভেম্বর ২৬ ১৬:৩৪:৪০
শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

হাফিজ আল আসাদ : শেয়ারবাজার পৃথিবীর উন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশেই শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজি গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং পরবর্তীতে একই উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমাদের শেয়ারবাজার অনেক বড় হয়েছে এবং বর্হিবিশ্বে পরিচিতিও পেয়েছে। পরিচিতি পেয়েছে এজন্য বললাম কারণ বড় হওয়া এক জিনিস এবং পরিচিতি পাওয়া ভিন্ন জিনিস। বেসিক্যালি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে শেয়ারবাজার আমজনতার কাছে পরিচিতি পেয়েছে ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই আমজনতাই আজ সাধারণ বিনিয়োগকারী। যাদের কষ্টার্জিত টাকায় শেয়ারবাজারে ভূমিকা রাখছে ।

বর্তমান শেয়ারবাজারের যে দুরাবস্থা চলছে, তা মোটামুটি শুরু হয়েছে বৈশ্বিক মহামারী করোনার পর এবং তারপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর। সর্বোপরি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে শেয়ারবাজারে। বর্তমান শেয়ারবাজারের যে নাজুক পরিস্থিতি সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা না পারছে পুরাতন শেয়ার বিক্রি করতে, না পারছে নতুন করে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে। অনেক ভালো ভালো শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে, কিন্তু কোন ক্রেতা নেই।

শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিএসইসির চেয়ারম্যান অনেক পরিশ্রম করছেন। বেসিক্যালি উনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর শেয়ারবাজার টানা প্রায় এক বছর ভালো ছিল। এই সময়ে বিনিয়োগকারীরা অনেকে লাভবান হয়েছেন, অনেকের ক্ষতি কিছুটা কমে এসেছে। তারপর সেই একই ধারা, বিনিয়োগকারীরা সর্বসান্ত হওয়ার পথে।

আমি লেখার প্রথম অনুচ্ছেদে বলেছি দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেয়ারবাজার আমজনতার কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। আগের আমলে ১৯৯৬ সালে শেয়ারব্যবসা করে কিছু মানুষ রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছে এবং কিছু মানুষ নিজের শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শেয়ারবাজার কিছুদিন ভালো গেলে অর্থাৎ সূচক বৃদ্ধি পেলে আবার কিছু কারেকশন হয় বা নিম্নগামী হয়-- এটাই শেয়ারবাজারের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের দেশের মতো বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব হওয়া অন্য দেশে সচরাচর দেখা যায় না। এই যে শেয়ারবাজার মাঝে মাঝে ভালো যায়, তার পিছনে শেয়ারবাজারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তা ৯০ শতাংশ শেয়ারের ক্ষেত্রে যায় না। এর পুরো দায়ভার গুজব এবং লোভের। শেয়ারবাজারের সূচক যখন নিম্নমুখী হতে থাকে, তখন চারদিকে হইচই পড়ে যায় এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেয়ারবাজারের কর্তা ব্যক্তিরা ও বিভিন্ন স্টেক হোল্ডাররা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন এবং বিভিন্ন দিক থেকে শেয়ারবাজার সম্বন্ধে বিভিন্ন মন্তব্য আসতে থাকে। এই সময়ে যত মন্তব্য আসে, তার মধ্যে কমন মন্তব্য হলো-১. শেয়ারবাজারে মূলধন ঘাটতি, তাই বাজারে মূলধনের যোগান দিতে হবে; ২.) বাজারে ভালো শেয়ারের অভাব, তাই বাজারকে ভালো করার জন্য ভালো কোম্পানি আনতে হবে; ৩. বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব ইত্যাদি। এমতাবস্থায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার লস দিয়ে বিক্রি করতে থাকেন। আসলে আমাদের এখানে বিনিয়োগকারীরা লোভে পড়ে হুজুকে শেয়ার ক্রয় কিনে এবং পরে হতাশায় বা আবেগে শেয়ার বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই যে উপরে বললাম বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলেন টাকার অভাব? ভালো শেয়ারের অভাব? আস্থার অভাব? আসলে কি তাই? আমার কাছে মনে হয় আস্থার অভাব- এই কথাটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। একটি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা থেকে লেনদেন পর্যন্ত মোটামুটি অনেকগুলো পক্ষ থাকে যেমন ইস্যু ম্যানেজার, আন্ডার রাইটার, অডিটর ফার্ম, ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ বিনিয়োগকারী । আলোচ্য পক্ষগুলো ছাড়াও আরো একটি ইনভিজিবল পক্ষ থাকে- যাকে বলে গ্যামবলার। আমার কাছে মনে হয় সব পক্ষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারী। কারণ শেয়ারবাজারের বেশিরভাগ আইন কানুনগুলোর সুবিধা মালিকদের পক্ষে যায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লাভ তথা সুরক্ষা দেওয়ার আইন শেয়ারবাজারে নেই বললেই চলে। তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সম্প্রতি আরএনস্পিনিং ও ফার কেমিক্যাল একিভূত হওয়া। একটি শেয়ারকে শেয়ারবাজারে আনতে প্রথমে যে কথাটা কর্তাব্যক্তিরা গুরুত্ব সহকারে বলেন, সেটা হল আপনারা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হন, তালিকাভুক্ত হলে আপনারা অন্যদের তুলনায় ট্যাক্সে বেশি সুবিধা পাবেন। আপনাদের ব্যাংকের মত নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে না। তার মানে একটি কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের মাথায় প্রথমেই সেট হয়ে যায় যে আমরা যদি শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত হই তাহলে আমরা বিনিয়োগকারীদের ইচ্ছামত ডিভিডেন্ড দেবো, আমাদের কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান শেয়ারবাজারে এখনো অনেক ভালো ভালো কোম্পানি আছে, যেগুলো আয়ের ৭০ শতাংশ বা তার বেশি ডিভিডেন্ড আকারে বিনিয়োগকারীদের দিয়ে দে।য় কিন্তু যাদের কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, সেখানে দেখা যায় তারা বিনিয়োগকারীদের ঠিকমত ডিভিডেন্ডে দেয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- একটি প্রতিষ্ঠানের ইপিএস ১৬ টাকা বা ১২ টাকা দেখা যায়, তারা বিনিয়োগকারীদের দেয় ৪ টাকা বা ৩ টাকা ডিভিডেন্ড হিসাবে দেয়। এখানে কেন বিনিয়োগকারীদের ঠকানো হলো?

আবার কোন কোন কোম্পানি বছরের পর বছর কোন এজিএম করে না, ডিভিডেন্ড দেয় না। প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর কেন তারা এভাবে চলে? আবার দেখা যায় কোন একটা কোম্পানির পরিচালকরা দুর্নীতি করে তাদের ধারণকৃত শেয়ারগুলো সব বিক্রি করে দিচ্ছে। তখন নীতি নির্ধারক ব্যক্তিরা দেখেন না। কিন্তু একেবারে কোম্পানিটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়ার পর উনাদের হঠাৎ করে মনে হয় এই কোম্পানিটা দেউলিয়ার পথেতো, একে ডিএসই-তে রাখা যাবে না, ওটিসিতে পাঠাতে হবে এবং সে অনুযায়ী ওটিসিতে পাঠিয়ে দিল। এটার সর্বশেষ উদাহরণ ইউনাইটেড এয়ারওয়েস। যার ফলে এক লক্ষ ৬০ হাজার বিনিয়োগকারী মানবতার জীবনযাপন করছে দীর্ঘ তিন বছর যাবত।

এটা লেখার কারণ, যখন যারা শেয়ারবাজারের কর্তাব্যক্তি থাকেন তারা শেয়ারবাজার উন্নয়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেন দৌঁড়াদৌঁড়ি করেন। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার মনে হয় দৃশ্যত কোন লাভ হয়নি। আসলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে কোন লাভ হয় না, লাভ যদি কোথাও থাকে তাহলে সেখানে কাউকে ডাকতে হয় না, বিনিয়োগকারী এমনিই চলে আসে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে "মানুষ লাভে লোহা বয় বিনা লাভে তুলাও বয়না।" তাই আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয় এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি/দৌঁড়াদৌঁড়ি না করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিভাবে লাভবান হয়, কিভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজির সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেটা বের করতে পারলেই শেয়ারবাজার নিয়ম-ধর্ম-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চলবে। আর তা না হলে গুজব এবং গ্যামবলাররাই বাজারের নিয়ন্ত্রণকর্তা হবে।

(লেখক শেয়ারবাজারের একজন বিনিয়োগকারী)

শেয়ারনিউজ, ২৬ নভেম্বর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে